ঢাকা ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নোনা গোলের মিঠা গুড়

নোনা গোলের মিঠা গুড়

বৈপরীত্যে ভরা গোলগাছ। নাম তার ‘গোল’ অথচ পাতাগুলো সব নারকেল পাতার মতো লম্বা। নোনাজল-মাটি ছাড়া গোল হয় না। গোলগাছের শরীরজুড়েও নোনতা স্বাদ। কিন্তু এই গাছেই মজুত থাকে সুমিষ্ট গাঢ় রস। এই রস জ্বালিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু গুড়। উপকূলের কৃষকরা প্রাচীনকাল থেকেই গোলগাছের এই রস দিয়ে গুড় তৈরি করে আসছেন। এখন সেটা বাণিজ্যিক রূপ পেয়েছে। শুধু গুড় নয়, গোলগাছের পাতা, ডাঁটা- কোনো কিছুই ফেলনা নয়। গোলপাতায় ঘরের ছাউনি, ডাঁটা দিয়ে চাটাই, ঘরের বেড়া, এমনকি জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত হয়। নোনাজলে জন্ম তার। সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নোনা। অথচ এর ডগা থেকে বেরিয়ে আসছে সুমিষ্ট রস। সেই রস দিয়ে তৈরি হচ্ছে গুড়। সুস্বাদু এই গুড়ের চাহিদাও ব্যাপক। বলা হচ্ছে গোলের গুড়ের কথা। এতে রয়েছে পুষ্টিসমৃদ্ধ উপাদান, বিশেষ করে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের খনিজ লবণ পাওয়া যায় গোলের গুড়ে, যা স্বাস্থ্য ভালো রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে শরীরকে সুরক্ষা দেয়। স্থানীয়ভাবে প্রচলন আছে, গোলের রস খেলে পেটের কৃমি যেমন দমন হয়, তেমনি কর্মক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। বরগুনার তালতলী উপজেলায় ৯০ হেক্টর জমিতে গোলগাছের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। সবচেয়ে বেশি গুড় আসে বেহালা গ্রাম থেকে। এক মৌসুমে প্রায় ১২ হাজার টন গুড় উৎপাদন হয়। গোলগাছের রস সংগ্রহ করে বড় একটি পাত্রে রেখে দীর্ঘ সময় চুলায় সিদ্ধ করে তৈরি হয় গুড়। এই গুড় এতটাই জনপ্রিয় যে, ভারতের কলকাতাসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। প্রান্তিক গ্রামের গোলচাষি নির্মল হাওলাদার। প্রতিদিন রস থেকে মিষ্টি গুড় তৈরি করে বিক্রি করেন। এ কাজে তার মা ও স্ত্রী সাহায্য করেন। শীতের মৌসুমে কয়েক মাস গোলগাছের রস ও গুড় বিক্রি করে চলে তাদের সংসার। তালতলী উপজেলার করইবাড়িয়া ইউনিয়নের বেহেলা গ্রামের গোলচাষি নির্মল হাওলাদারের আট সদস্যের পরিবার। জীবিকার তাগিদে গোলগাছের রস দিয়ে গুড় তৈরি করে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। নিজের কোনো জমিজমা না থাকায় অন্যের গোলগাছ চুক্তি নিয়ে প্রতি বছর শীত মৌসুমে এ কাজ করেন তিনি। নির্মল হাওলাদারের মতো ওই এলাকায় ১৫০ জনের বেশি গোল চাষির সংসার চলছে গোলের রস ও গুড় বিক্রি করে। এতে বেহেলা গ্রাম থেকে বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার গুড় বিক্রি হচ্ছে বলে তারা জানান। প্রতিটি ডগা থেকে ২৫০-৫০০ গ্রাম পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। নির্মল হালদার এ বছর এক একর জমির ১৫০টি ডগা থেকে প্রতিদিন রস সংগ্রহ করছেন চার কলস। প্রতি কলসে রস ধারণক্ষমতা ২৫ থেকে ৩০ লিটার। প্রতিদিন ১০০ লিটার রস সংগ্রহ করেন। তরল রস আগুনে জ্বাল দিয়ে প্রতি কলসে প্রায় সাড়ে তিন কেজি গুড় পাওয়া যায়। এছাড়া গাছের তিন-চার ফুট লম্বা পাতা দিয়ে তৈরি হয় ঘরের ছাউনি। ১০০ পিস ছাউনি বিক্রি করা হয় ৬০০ টাকায়। প্রায় ১০ থেকে ২০ ফুট লম্বা ডগাসহ গোলপাতা ৮০টি বিক্রি করা হয় ৪০০ টাকায়। আরেকজন গাছি রমনি হালদার। তিনি বলেন, ভোর ৪টায় রস সংগ্রহ করা শুরু করি। তারপর মহিলারা রস চুলায় বসিয়ে তাপ দেওয়া শুরু করে। পরে রস থেকে তৈরি হয় গুড়। প্রথমে গোলের রসের চাহিদা কম থাকলেও এখন চাহিদা বেড়েছে। দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি জানান, প্রথমে ভারতের কলকাতায় থাকা তাদের কিছু স্বজনের উপহার হিসেবে পাঠান গোলের গুড়। এরপর সেখানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই গুড়। সেই স্বজনরা তাদের কাছে গুড় কেনার কথা জানালে তারা বিক্রি শুরু করেন। প্রথমে প্রতি কেজি ২৫০ টাকা বিক্রি করলেও এখন ২৮০ টাকা। রমনি হালদারের স্ত্রী প্রিয় বালা রানী বলেন, ১ থেকে ২ ঘণ্টা তাপ দেওয়ার পর তরল রস গুড়ে পরিণত হয়। বেহালা গ্রামের কৃষ্ণকান্ত মিস্ত্রি বলেন, গোলের গুড় সুনাম কুড়িয়েছে। বেহালা গ্রামের ঐতিহ্য এখন ক্ষুদ্র শিল্পে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমন হাওলাদার বলেন, উপজেলার বেহলা গ্রামের গোল চাষের ইতিহাস শত বছরের। এখানকার গোলের গুড় খুব সুস্বাদু। স্থানীয় গোলচাষিরা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই গুড়ে কোনো ধরনের ভেজাল নেই। আমরা আশা করছি, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ নিয়ে এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গোলগাছের গুড় তৈরি করে এখন ভালো আয় করছেন সাগরতীরের বরগুনার তালতলী এবং পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার অনেক কৃষক। গোলগাছ চাষে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক লাগে না। এর কোনো পরিচর্যাও লাগে না। এমনকি গুড় তৈরি, সংরক্ষণে কোনো রাসায়নিকও ব্যবহৃত হয় না। লবণাক্ত পলিযুক্ত মাটিতে জন্মানো গোলগাছের কাণ্ড থেকে রস বের করার কৌশলটি অদ্ভুত। তালতলী বেহালা গ্রামের চাষি দিলীপ কুমার হাওলাদার জানান, আষাঢ় মাসে গোলগাছের কাণ্ডে ফল ধরে। স্থানীয়ভাবে এই গোল ফলকে ‘গাবনা’ বলা হয়। অগ্রহায়ণে ফল ধরার পর এর কাণ্ডটি ভারে কিছুটা নুয়ে পড়ে। এরপর কাণ্ডটিকে আলতো করে টেনে নুইয়ে মাটির কাছাকাছি নিয়ে নিচ থেকে টানা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। এরপর পৌষের শুরুতে নোয়ানো এই কাণ্ড পা দিয়ে আলতো করে ৫ থেকে ৭ মিনিট ধরে মালিশের মতো করে দিতে হয়। একে স্থানীয় ভাষায় ‘দোয়ানো’ বলে। এতে গাছের রস ওই কাণ্ডে জমা হয়। ১৫ দিন ধরে এভাবে দোয়ানোর পর একদিন কাণ্ড থেকে ফলটি কেটে ফেলা হয়। প্রক্রিয়াটি এখানেই শেষ নয়। এরপর রস পেতে অপেক্ষা করতে হয় আরও অন্তত ১০ দিন। ফল কাটার পর কাণ্ডটিকে তিন দিন শুকাতে সময় দিতে হয়। তিন দিন পর কাণ্ডের মাথার দিকে পাতলা করে চেঁছে দেওয়া হয়। এক সপ্তাহ ধরে চাঁছার পর কাণ্ডের মাথা থেকে বের হতে থাকে সুমিষ্ট আর গাঢ় রস। ছোট ছোট হাঁড়ি বা ঘট বেঁধে সে রস সংগ্রহ করেন চাষিরা। রাতভর ফোঁটা ফোঁটা করে হাঁড়িতে জমা রস সকালে সংগ্রহ করে উনুনে জ্বাল দিয়ে ঘন করে তৈরি করা হয় গোলের গুড়। পৌষ থেকে ফাল্গুন- তিন মাস ধরে এভাবে চলে রস সংগ্রহ আর গুড় তৈরির কাজ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত