দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার বাড়ছে
প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিয়ান স্ট্যালিন
মানবজাতিতে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। খামার থেকে টেবিল পর্যন্ত টেকসহ পুষ্টির জন্য দুধ একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধান। দুগ্ধজাত খাবার, যেমন পনির ও দই আদর্শগতভাবে হেলদি অ্যাজিং প্রোডাক্ট হিসেবে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (২০১৫) নির্দেশিকা অনুযায়ী, হেলদি অ্যাজিং হলো কার্যকর ক্ষমতার বিকাশ এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার প্রক্রিয়া, যা বার্ধক্যে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। ক্যালসিয়াম, ফসফেট, ভিটামিন ডি এবং প্রোটিন মানবদেহের জন্য মূল পুষ্টি উপাদান, যা পেশিভর ও গুণমানকে প্রভাবিত করে। দুগ্ধজাত দ্রব্য বয়স্কদের জন্য পুষ্টি সরবরাহ করে, পেশির স্বাস্থ্য বজায় রাখে এবং স্কেলেটাল মাসল মাস ও শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে সারকোপেনিয়া (বার্ধক্য প্রক্রিয়ার একটি মূল বিবেচ্য বিষয়) প্রতিরোধে সহায়তা করে। তাই দুগ্ধজাতদ্রব্য বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য হেলদি ফুড হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই বয়স্কদের পনির ও দই (প্রোবায়োটিক দই) প্রদানের মাধ্যমে সারকোপেনিয়ার ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। অন্যদিকে এ ধরনের পুষ্টিসমৃদ্ধ দুগ্ধজাত দ্রব্য গ্রহণ বিপাকীয় রোগ এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের প্রকোপ কমায় এবং কিডনির কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। সম্প্রতি এক গবেষণায় (ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন রিসার্চ ২০১৬) পাওয়া যায় যে একটি স্বাভাবিক খাদ্যতালিকায় দুগ্ধজাত দ্রব্য যোগ করা হলে এর গুণগতমান বৃদ্ধি পায়; যা বয়স্ক জনগোষ্ঠীর পেশিশক্তি হ্রাস রোধে সহায়তা করে। দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার প্রোটিনের একটি ভালো উৎস। স্বল্প ফ্যাটযুক্ত, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ দুগ্ধজাত পণ্যগুলো সাধারণত রক্তচাপ কমায় এবং ২০০-৩০০ মিলি/দিন দুধ গ্রহণে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে না বলে সম্প্রতি গবেষণায় (ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন রিসার্চ ২০১৬) পাওয়া যায়। দুগ্ধপ্রোটিন, যেমন কেসিন ক্ষুদ্রান্ত্রে ক্যালসিয়াম ও ফসফেট শোষণকে সহজ করে এবং এটি বায়ো-অ্যাকটিভ পেপটাইড উৎপাদনের প্রধান উপাদান। দুগ্ধজাত পেপটাইডগুলো মানুষের ক্ষুদ্রান্ত্রে দুধের প্রোটিনের পরিপাক থেকে উদ্ভূত হয়ে অক্ষতভাবে শোষিত হয়। এই বায়ো-অ্যাকটিভ অণুগুলোর মধ্যে কয়েকটি ল্যাকটোট্রাইপেপটাইড পাওয়া যায়, যা অ্যানজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইমকে (এসিই) বাধা দিয়ে রক্তচাপ কমায়/নিয়ন্ত্রণ করে। অ্যানজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম (এসিই) একটি ভ্যাসোকন্সট্রিক্টর এবং এটি অ্যালডোস্টেরন নিঃসরণকে উদ্দীপ্ত করে, যা কিডনি দ্বারা সোডিয়াম এবং পানি ধারণ করে রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি করে হেলদি অ্যাজিংয়ে সহায়তা করে। বিশ্বে গরুর দুধ উৎপাদন ২০১০ সালে ৪৪১ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন টন থেকে ২০১৯ সালে ৫২৪ দশমিক ৪১ মিলিয়ন টন হয়েছে; অর্থাৎ এই সময়ে ১৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে (ইউএসডিএ, ২০২০)। মাথাপিছু গ্রহণ বিশ্বব্যাপী গড়ে ৭৮ দশমিক ২৪ কেজি (২০১৯) থেকে ১১১ দশমিক ৬ কেজিতে (২০২০) উন্নীত হয়েছে; অর্থাৎ এই সময়ে ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে (এফএও, ২০২০)। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯-২১ অর্থবছরে দুধের চাহিদা ছিল ১ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার মেট্রিক টন (জনপ্রতি চাহিদা ২৫০ মিলি ধরে), যার বিপরীতে উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৮০ হাজার মেট্রিক টন। ফলে জনপ্রতি দুধের প্রাপ্যতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৫ দশমিক ৬৩ মিলি। দুগ্ধ খামারের প্রতি বাংলাদেশের কৃষকদের আগ্রহের কারণে প্রায় প্রতি বছর দেশে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে দুধের মোট উৎপাদন ৮ শতাংশ বেড়ে প্রায় ১ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে। প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো সিরাজগঞ্জ জেলায় গাভি পালন ও দুধ উৎপাদনের ইতিহাস। এই জেলায় উৎপাদিত গরুর দুধ সারা দেশে চলে যায়। তবে জেলার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের তৈরি বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য দীর্ঘদিনেও বড় বাজার ধরতে পারেনি। যথাযথ উৎপাদন ও বিপণন পদ্ধতি না থাকাই এর কারণ। এখন অবশ্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে বলে জানান স্থানীয় উদ্যোক্তারা। এই জেলার কয়েকটি উপজেলায় কয়েক শ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঘি, চিজ বা পনির, ছানা, লাবান, হোয়ে মিল্ক, মিষ্টি, দইসহ বিভিন্ন ধরনের দুগ্ধজাত পণ্য তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। খামারিরা বলেছেন, মাত্র এক বছরের ব্যবধানেই খৈল, ভুষির মতো গোখাদ্য এবং ওষুধের দাম ব্যাপক হারে বেড়েছে। এর মধ্যে খৈলের দাম ৩৭-৩৮ টাকা থেকে বেড়ে ৫০-৫৩ টাকা, ভুষির দাম ৪০-৪১ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮-৪৯ টাকা হয়েছে। ক্যালসিয়ামের মতো নিয়মিত ওষুধের দাম (প্রায় প্রতি মাসেই কিনতে হয় খামারিদের) প্রতি লিটার ১৪০-১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২০০ টাকা হয়েছে। খামারিরা জানান, গত ৫ বছরে গোখাদ্যের দাম দ্বিগুণ বাড়লেও খামার পর্যায়ে লিটারপ্রতি দুধের দাম বেড়েছে মাত্র ১০ টাকা, আর শেষ ২ বছরে বৃদ্ধির হার শূন্য পর্যায়ে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে দুগ্ধ খামারি আছেন প্রায় ৩০ হাজার। প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হয় ৫ লাখ লিটার। বড় দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানি ও ছোট দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানি মিলে প্রতিদিন খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে সাড়ে ৩ লাখ লিটার। বড় কোম্পানির মধ্যে মিল্কভিটা, আড়ং, প্রাণ, ইগলু ও আকিজের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র রয়েছে শাহজাদপুরে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে দুগ্ধ খামারির সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। ২০২২-২৩ বছরে ১.৪০ কোটি টন দুধ উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম সারির দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলো ৭-৮ লাখ টন দুধ প্রক্রিয়াজাত করে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য প্রস্তুত করছে। বাকি দুধ খামারিরা মিষ্টির দোকান, খোলাবাজারে বিক্রি করছেন। খোলাবাজারে বিভিন্ন সময়ে প্রতি লিটার দুধ ৬০ থেকে ৭৫ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয় বলে জানান খামারিরা। প্রতিনিয়ত চাহিদার উঠানামার কারণে বড় খামারিরা তাদের উৎপাদিত দুধ খোলাবাজারে সবসময় বিক্রি করতে পারেন না বলে বাধ্য হয়েই প্রসেসর কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দুগ্ধজাত পণ্যের দাম বেড়েছে। কিছুদিন ধরে নিলামে দুগ্ধপণ্যের দামে নিম্নমুখিতা বজায় ছিল। তবে ২০১৮ সালের শুরু থেকে আন্তর্জাতিক নিলামগুলোয় পণ্যটির বাজার পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। সর্বশেষ গ্লোবাল ডেইরি ট্রেড অকশনে (জিডিটি) দুগ্ধপণ্যের গড় মূল্যসূচক আগের নিলামের তুলনায় প্রায় ৬ শতাংশ বেড়েছে। দুগ্ধপণ্য উৎপাদনকারী শীর্ষস্থানীয় দেশ নিউজিল্যান্ডে তরল দুধ উৎপাদন কমার সম্ভাবনা থেকে আন্তর্জাতিক নিলামে দুগ্ধপণ্যের গড় মূল্যসূচক ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। খবর রয়টার্স। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার টন গুঁড়ো দুধ ও ক্রিম আমদানি করেছে, যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সংশ্লিষ্টরা বলেন, চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই সংসারের খরচ সাশ্রয়ে দুগ্ধজাত খাবার ও দুধ চা পান করা কমিয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে গুড়া দুধ ও ক্রিম আমদানি আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৬ শতাংশ কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি ও সংসারের খরচের ব্যাপারে সাশ্রয়ী হওয়ায় আমদানি কমেছে।