ঝুট কাপড় থেকে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিয়ান স্ট্যালিন
ঝুটপট্টিতে প্রায় ৭০০ দোকান আছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস ওয়েস্ট প্রসেসরস অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিজিডব্লিউপিইএ) প্রতিবেদনে বলা হয়, দারুণ সম্ভাবনাময় একটি খাত হতে পারে ঝুট রপ্তানি। আর বিজিএমইএ সূত্রে জানা যাচ্ছে, দেশে বছরে চার লাখ টন ঝুট উৎপাদন হয় এবং ৩০০ কোটি টাকা আয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিটিজিডব্লিউপিই এর সদস্যদের অনেকেই ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্কসহ ইউরোপের আরো দেশে ঝুট রপ্তানি করে। গত পাঁচ বছরের হিসাবে যার অর্থমূল্য গড়ে ৫ থেকে ৬ কোটি ডলার। দেশে ঐতিহ্যবাহী কৌশল ব্যবহার করে কাপড় থেকে সুতা উৎপাদন করা হয়। এজন্য ছোট ছোট অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে নামটা ব্যবসায়ীদের বিপাকে ফেলে দিয়েছিল। অনেক ভাবনা-চিন্তা করে নাম ঠিক হয় মিরপুর কাটা কাপড় ব্যবসায়ী সমিতি। সমিতির হিসাবরক্ষক মো. মোজাম্মেল হককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন আপনারা ঝুট শব্দটি পছন্দ করেননি? তিনি বলেছিলেন, ‘কেমন যেন শোনায়! ঝুট মানে মিথ্যা, আমরা অর্থ করি পরিত্যক্ত বা উচ্ছিষ্ট। তাই উচ্ছিষ্ট কাপড় ব্যবসায়ী সমিতি রাখলে আপনিও হেসে ফেলতেন।’ তিনি জানান, ‘আমাদের সমিতির নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে সমাজসেবা দপ্তর থেকে। যখন নিবন্ধন নিতে গিয়েছিলাম, তখনই প্রশ্নটা সামনে চলে আসে। শেষে ওই নাম রাখা হয়। প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি, জ্যাকেট, সোয়েটার বানানোর পর কাপড়ের যে অংশটা কাটা বা বাদ পড়ে, সেগুলো আমরা নিয়ে এসে বিভিন্ন কাজে লাগাই। এজন্য নামটা জুতসই।’ সম্ভাবনাময় একটি খাত ঝুট রপ্তানি। বিজিএমইএ সূত্রে জানা যাচ্ছে, দেশে বছরে চার লাখ টন ঝুট উৎপাদন হয় এবং ৩০০ কোটি টাকা আয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্কসহ ইউরোপের আরো অনেক দেশে ঝুট রপ্তানি হয় বাংলাদেশ থেকে। গত পাঁচ বছরের হিসাবে যার অর্থমূল্য গড়ে ৫ থেকে ৬ কোটি ডলার। দেশে ঐতিহ্যবাহী কৌশল ব্যবহার করে কাপড় থেকে সুতা উৎপাদন করা হয়। এজন্য ছোট ছোট অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গ বিশেষ করে দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কিশোরগঞ্জ, পাবনার ঈশ্বরদী, নওগাঁ ও কুড়িগ্রামে। ঝুট শব্দটার উৎস কোথায়? উত্তর পেতে ঘুরতে হলো, পরিষ্কার উত্তর পাওয়াও গেল না। ব্যবসায়ী সোহেল প্রধান বললেন, ‘আগে ঝুট কাপড় রাস্তায় গড়াগড়ি খেত। যখন ব্যবসায়িক সম্ভাবনা দেখা দিল, তখন কাড়াকাড়ি শুরু হলো। একপর্যায়ে মারামারি। অনেক ছল-চাতুরি আছে এ ব্যবসায়। ফার্স্ট থেকে লাস্ট, সব পার্টিই তালে থাকে কখন কার মাথায় কাঁঠাল ভাঙা যায়। এ কারণেই হয়তো কেউ বলে থাকবেন, ইয়ে সব ঝুট হ্যায়।’ কিন্তু কাজটি পরিবেশবান্ধব, সিনথেটিক ঝুট যেমন প্রকৃতিতে মিশে যায় না, জমে থাকলে দূষণ ছড়াত। তাছাড়া অনেক কর্মসংস্থানও হচ্ছে এ খাতে। প্রকৃতিতে মিশে যায় না- প্রসঙ্গটি তুললে সোহেল বললেন, ‘এটা ঠিক। আমরা পরিবেশের দূষণ কমাচ্ছি। ফুটপাতে ১০০ টাকায় প্যান্ট-শার্ট-গেঞ্জি পাওয়া যায়; তা কিন্তু এই ঝুটপট্টিরই অবদান। তবে যারা ঝুট বাছাইয়ের কাজ করে, তারা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকে। এ ব্যাপারে নজর দিলে আরো ভালো হতো।’যেভাবেই আসুক, জায়গার নাম ঝুটপট্টিই রয়ে গেছে। মিরপুর ১০ নম্বরের ওই জায়গায় ঝুট বা কাটা কাপড়ের ব্যবসা শুরু হয় আশির দশকের শুরুতে। তবে জমে ওঠে নব্বইয়ের দশকে।
১৯৯৩ সালে ঝুট ব্যবসা শুরু করেন রশিদ মাতব্বর। আগে তিনি সিমেন্টের বস্তার ব্যবসা করতেন। তার সঙ্গে সখ্য ছিল এক গার্মেন্ট মালিকের ড্রাইভারের। কথায় কথায় ড্রাইভার বন্ধু রশিদকে ঝুট কাপড়ের কথা বলেন। রশিদ উৎসাহ দেখালে বন্ধুটি তাকে গার্মেন্টে নিয়ে যান। গিয়ে দ্যাখেন বেশ কিছু কার্টন নিচতলায় জমা করা আছে যেগুলো ভরতি ঝুট কাপড় দিয়ে। রশিদ ঠিকা চুক্তিতে কয়েকটি কার্টন কিনে আনেন। প্রতিটির ওজন ছিল সাত-আট কেজি। সে সময় ঝুট কেনা যেত নামমাত্র মূল্যে। অনেকে সেধেও দিয়ে দিত, জায়গা নষ্ট হচ্ছে ভেবে। কার কাছে বিক্রি করলেন নিয়ে আসা কাটা কাপড়গুলো? জানতে চাইলে রশিদ বললেন, ‘তখন ঝুটের ব্যবহার বেশি ছিল বালিশ, তোশক তৈরিতে। কিছু পাইকার আসত জিনজিরা, কালীগঞ্জ থেকে। তারা বেশি দৈর্ঘ্যরে ঝুট নিয়ে গিয়ে জোড়াতালি দিয়ে শার্ট-প্যান্ট বানাত।’ উত্তরবঙ্গ বিশেষ করে দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কিশোরগঞ্জ, পাবনার ঈশ্বরদী, নওগাঁ ও কুড়িগ্রামে। মিরপুরের ঝুটপট্টি থেকে প্রতিদিন গড়ে ২০টি ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং ভারত অভিমুখে ছুটে যায়। প্রতিটি ট্রাকে গড়ে ৮ টন করে ঝুট থাকলে মোট ওজন দাঁড়ায় ১৬০ টন, অর্থাৎ ১ লক্ষ ৬০ হাজার কেজি। প্রতি কেজি ২৫ টাকা করে ধরলে ৪০ লক্ষ টাকার ঝুট দিনে বিক্রি হয় ঝুটপট্টি থেকে, জানালেন কাটা কাপড় ব্যবসায়ী সমিতির হিসাবরক্ষক মোজাম্মেল হক। তিনি আরো জানান, ১০-১২ হাজার শ্রমিকের এখানে কর্মসংস্থান হচ্ছে। ঝুট ও অ্যাক্সেসরিজের দোকান মিলে ৩০০টি দোকান সমিতিতে নাম লিখিয়েছে। ঝুট ব্যবসায়ীরা পণ্য বিক্রি করেন সমিতি মারফত। সমিতি ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দেয়, বাজারের শৃঙ্খলা বজায় রাখে। নিজস্ব পরিচ্ছন্নতা কর্মীও আছে সমিতির। বিনিময়ে সমিতি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মুনাফার ১ শতাংশ গ্রহণ করে থাকে।
বাছাইকারীরা মজুরি পায় ২০০ বা ২৫০ টাকা। বাছাই শেষে ছাট বা কাটা কাপড়, মানে ঝুট বিক্রি হয় ২৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে। ঝুট কাপড়ের অধিকাংশই রপ্তানি হয় চীন ও ভারতে। মোটাদাগে ঝুটপট্টির কাপড়গুলো দুই ধরনের- পুনর্ব্যবহারযোগ্য (ইনট্যাক্ট) ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতযোগ্য (ঝুট)। ঝুট থেকে প্রথমে তুলা তারপর সুতা, আর সুতা হয়ে গেলে তা থেকে নতুন কাপড়। সিনথেটিক (কৃত্রিম) তন্তুর প্রক্রিয়াজাতকরণও শুরু হয়েছে আমাদের দেশে। গেঞ্জির কাপড়ের ঝুটের (কাটপিস নামে পরিচিত) অবশ্য বিশেষ একটা ব্যবহার আছে- সেটা পরিষ্কারক হিসেবে, আর তা বন্দুকের নল থেকে কম্পিউটারের কিবোর্ড পর্যন্ত। ১০০-১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় এগুলো। বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি সূত্রে জানা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে কৃত্রিম তন্তুর পোশাকের চাহিদা ৭০ ভাগ ছাড়িয়ে যাবে শীঘ্রই। কৃত্রিম তন্তুর সুতা ও কাপড় তৈরিতে বিনিয়োগ বাড়ছে আমাদের দেশেও। এখন দেশে ৭০টি কারখানা পলিয়েস্টার ও ভিসকস কাপড়ের কৃত্রিম তন্তু থেকে সুতা তৈরি করছে। বিটিএমএ তাই ঝুট রপ্তানি বন্ধ করার পক্ষে।