বৈশ্বিক নৌশক্তির নতুন যুগ!

প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক

এবার যুদ্ধের পরিধি বাড়ছে। বিশ্ব বাণিজ্য ঠিকঠাক রাখতে ১২ জানুয়ারি ইয়েমেনে ৬০টিরও বেশি হুতি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। এই হামলাকে বলা হচ্ছে, বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ‘পানিপথে’ নৌ চলাচলের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা। লোহিত সাগরে হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলা, মধ্যপ্রাচ্যের ওই অঞ্চলে জাহাজ চলাচলকে হুমকির মধ্যে ফেলে। সুয়েজ খাল ব্যবহার না করে, অনেক জাহাজ আফ্রিকা ঘুরে পণ্য পরিবহণ শুরু করে। তাতে সময় ও টাকা দুটোই বেশি লাগে। বাড়ে মূল্যস্ফীতি। কিন্তু এই হামলায় নাটকীয়ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের ভৌগোলিক পরিধি বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে দ্য ইকোনমিস্ট। এদিকে, তাইওয়ানের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমারা বলছে, এটি এমন একটি নির্বাচন যা দ্বীপটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেবে। এমনকী প্রশান্ত মহাসাগরের বাইরে চীন-আমেরিকা নৌযুদ্ধের একটি আশঙ্কাও আছে। অন্যদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মোড় নিতে পারে কৃষ্ণ সাগর ও ক্রিমিয়াতে আধিপত্য বিস্তার বা ধরে রাখার লড়াইয়ে। মোট কথা, বিশ্বে আবারো নৌশক্তি প্রদর্শনের দিন ফিরে এলো বলা যায়। তাহলে নৌশক্তিতে কে এগিয়ে? পশ্চিমা জোটের অবস্থান বেশ উজ্জ্বল। আমেরিকা ও তার মিত্রদের কাছে এখনও সবচেয়ে উন্নত সাবমেরিন আছে। তাদের নৌ জোট অন্যদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তবে, এটাও সত্য তাদের নৌ আধিপত্য হ্রাস পাচ্ছে। এককভাবে চীনের নৌ বাহিনী এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌ বাহিনী। আমেরিকান শিপইয়ার্ডগুলো জৌলুস হারিয়েছে।

ইউরোপীয় নৌবাহিনী এখন আর আগের মতো নেই। ১৯৯৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তারা ২৮ শতাংশ সাবমেরিন এবং ৩২ শতাংশ ফ্রিগেট ও ডেস্ট্রয়ার কমিয়ে দিয়েছে। যাইহোক, সমুদ্র এখনো বিশ্ব অর্থনীতির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্লার্কসির হিসাবে গত দশ বছরের তুলনায়, ২০২৩ সালে বিশ্বের শিপিং বহরের গড়ে দৈনিক আয় ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। সমুদ্রপথে বাণিজ্য ৩ শতাংশ বেড়ে ১২.৪ বিলিয়ন হয়েছে। বিশ্বজুড়ে জাহাজ নির্মাণ ১০ শতাংশ বেড়েছে। প্রথমবারের মতো চীন এসব জাহাজের অর্ধেক নির্মাণ করছে। পরিমাপ হিসাব করলে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ, মূল্য বিবেচনা করলে ৫০ শতাংশ হয়েছে, সমুদ্রপথে। সমুদ্রপথে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হলে কী ক্ষতি হয়, তা সবার জানা। কোভিড-১৯ মহামারির সময় বিশ্বজুড়ে সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ে। এক বছর পর কন্টেইনার জাহাজ এভার গিভেন আটকা পড়ে সুয়েজ খাল বন্ধ হয়ে যায়। ২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে খাদ্য শস্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। আর সম্প্রতি লোহিত সাগরে হুতিদের হামলা এশিয়া-ইউরোপ মালবাহী শিপিং খরচ প্রায় তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সাগরে শুধু পণ্য পরিবহন হয় না। ডাটা অ্যানালাইসিস ফার্ম টেলিজিওগ্রাফি জানিয়েছে, সমুদ্রে ৫৭৪টিরও বেশি সাবমেরিন টেলিকম ক্যাবল সক্রিয় আছে। যা ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ট্র্যাফিকের ৯৭ শতাংশ সরবরাহ করা হয়। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ এই অবকাঠামোকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। ২০২২ সালে বাল্টিক সাগরের মধ্য দিয়ে নর্ডস্ট্রিম ১ এবং ২ গ্যাস পাইপলাইন অজানা হামলাকারীরা উড়িয়ে দেয়। এক বছর পর এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের মধ্যে ডেটা ক্যাবল রহস্যজনকভাবে কেটে ফেলা হয়। এদিকে, চীন-আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূল বিষয় হচ্ছে এশিয়ায় সামুদ্রিক আধিপত্য। দক্ষিণ চীন সাগরে, চীনের দাবির বিরুদ্ধে এক জোট হচ্ছে আমেরিকা ও তার মিত্ররা। অন্যদিকে তাইওয়ানের চারপাশে নৌমহড়ার আকার এবং ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি করছে চীন। গভীর সম্রুদে আধিপত্য ধরে রাখতেও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো ভাঙছে আন্তর্জাতিক আইন। সমুদ্র আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘের কনভেনশন (আনক্লোজ) অনুযায়ী একটি দেশের উপকূলে ২০০ নটিক্যাল মাইল সে দেশের এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এই সীমানা নিয়েও অনেক রাষ্ট্রের বিরোধ আছে। আমেরিকা আনক্লোজ স্বাক্ষর করেনি; চীন মূল বিধানগুলো উপেক্ষা করছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সাগর-মহাসাগরগুলোতে পরাশক্তিরা নিজেদের আধিপত্য চাইছে। আর একই সঙ্গে ফিরে আসছে নৌশক্তির দিনও।