হাতবদলে কৃষকের লাভ কমছে
প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিয়ান স্ট্যালিন
উত্তরবঙ্গের সীমান্ত ঠাকুরগাঁওয়ের বর্গাচাষি রফিকুল ইসলাম। নিজের সঞ্চয়, আত্মীয়স্বজনদের কাছে থেকে নেওয়া ধার ও এনজিওর ঋণ নিয়ে এ বছর আগাম আলুর আবাদ করেছিলেন। ৬ একর জমি আলুর আবাদে নিজের কয়েক মাসের পরিশ্রম বাদেও তার খরচ হয়েছিল ৬ লাখ টাকা। কিন্তু আলু বিক্রি করতে গিয়ে তার দীর্ঘশ্বাসের বোঝা ভারীই হচ্ছে। উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামও তিনি পাচ্ছেন না। রফিকুলের মতো সারা দেশের কৃষক ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন খাদ্য উৎপাদনে। তাদের পরিশ্রমেই জাতির খাদ্য নিরাপত্তা তৈরি হয়। চাষকৃত ফসলের ভালো দাম পাওয়ার, এমনকি নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের নিশ্চয়তা ছাড়াই তারা বছরের পর বছর কাজ করে যাচ্ছেন। ২০২২ সাল জুড়ে তারা খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে মাঠে কাজ করে গেছেন। যার ফলশ্রুতিতে জাতিকে কেবলমাত্র বিশ্ব বাজারের ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে। করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব বাজারে সরবরাহ শৃঙ্খলে যেমন প্রভাব পরেছে, তেমনি দামও বেড়েছে কয়েক গুণ। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, ডলার সংকট, জ্বালানি ও সারের মূল্যবৃদ্ধিসহ বাংলাদেশের অর্থনীতি অগণিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দিলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমাণে আমনের ফলন হচ্ছে।
ফসল উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। তবে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) অনুমান করছে, ২০২২ সালে আমন ধানের উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ টন, যা একটি রেকর্ড। ব্রির মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবির এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশের কৃষক আমনসহ প্রায় ৩ কোটি ৯৭ লাখ টন বিভিন্ন জাতের ধান উৎপাদন করেছে। যা দৈনিক মাথাপিছু ৪০৫ গ্রাম হারে ২ কোটি ৫২ লাখ টন ধানের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। তিনি বলেন, ‘কিছু ত্রুটি বিবেচনায় নিলেও আগামী জুন পর্যন্ত দেশে চালের কোনো সংকট থাকবে না।’ এছাড়া, মার্কিন কৃষি বিভাগ বাংলাদেশে আমন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুতে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে, বাংলাদেশে ২০২২ সালে ৫ কোটি ৬৪ লাখ টন ধান কাটা হবে, যা আগের বছরের তুলনায় সামান্য কম কিন্তু ৫ বছরের গড় ৫ কোটি ৪৯ লাখ টনের চেয়ে বেশি।
জাতিসংঘের সংস্থাটি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ২০২২ সালে বাংলাদেশে গম ও ভুট্টার বেশি উৎপাদন হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। কৃষকদের পরিশ্রমের ফলে সারা বছরজুড়ে সবজির উৎপাদন হয়েছে যথেষ্ট। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ অন্যান্য অপ্রত্যাশিত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের পরেও ধান ও শাকসবজির ক্ষেত্রে দেশকে প্রায় স্বনির্ভর করে তুলেছেন এই কৃষকরা। আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাওয়া, সেচ ও সারের খরচ বৃদ্ধিসহ শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কৃষক হাল ছাড়েননি। ২০২০ সালে যখন করোনা মহামারি বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছিল।বাংলাদেশও লকডাউন দিতে বাধ্য হয়েছিল। দশের তথা বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পরেছিল, তখনো মাঠে ছিলেন কৃষক। জাতির মুখে খাবার তুলে দিতে করোনার ঝুঁকির মধ্যেও তারা নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
বর্তমানে কৃষক একই মাঠে বছরে দুটির বেশি ফসল ফলান। ২০২০ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ ধান উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। গত মার্চে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচার ইনফরমেশন সার্ভিস জানিয়েছে, সবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। ইউএসডিএ আরেকটি প্রতিবেদনে বলেছে, ভারত ও চীনের পর বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। তবে কৃষকের প্রভাব ও তাদের সাফল্য আরও বেশি। এফএও’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টানা ১৮ বছরে বাংলাদেশে ফলের উৎপাদন গড়ে ১১ শতাংশ বেড়েছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম এবং পেঁপে উৎপাদনে ১৪তম। সরকার প্রতি বস্তা সারের দাম ১ হাজার ১০০ টাকা নির্ধারণ করলেও কৃষককে এরচেয়ে বেশি খরচ করতে হয়েছে। বাংলাদেশের চাষি, কৃষকদের এই বারমাস্য শতাব্দীপ্রাচীন। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরুর যে মিথ ঐতিহাসিক কোনো কালপর্বেই তার নজির খুব একটা পাওয়া যায় না। এখন রংপুরে প্রতি পিস বাঁধাকপি ২০ টাকা, ফুলকপি ৩৫ টাকায় বিক্রি করেন কৃষক। সেই বাঁধাকপি ও ফুলকপিই ঢাকায় এসে ‘বড়লোক’ হয়ে যায়। শীতের ভরা মৌসুমেই রাজধানীর বাজারে এখন মানভেদে প্রতি পিস বাঁধাকপি ৫০ আর ফুলকপি ৭০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। নরসিংদীতে ১ কেজি শিম কৃষক বিক্রি করেন ৩০ টাকায়। ঢাকায় সেই শিমের কেজি ৮০ থেকে ১২০ টাকা। বগুড়ায় যে লাউ প্রতি পিস ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়, ঢাকায় সেটি কিনতে হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। এভাবেই বেচাকেনার শুভঙ্করের ফাঁকিতে পড়ে যেমন ঠকছেন কৃষক, তেমনি ফাঁকা হচ্ছে ক্রেতাসাধারণের পকেট। সে কারণেই প্রশ্ন মাঠের ও হাটের দামে এত যে ব্যবধান তার ফায়দা লুটছে কারা? কৃষকের লাভের ‘গুড়’ খেয়ে যায় কোন পিঁপড়ায়? অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফল-ফসলের প্রায় প্রতিটি পণ্যই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকরা যে দামে বিক্রি করেন তা জেলা বা বিভাগীয় শহরে আসতে আসতে তিন গুণ থেকে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। বেশিরভাগ ফসলেই কৃষক মূল্য পেলেও, ন্যায্যমূল্য পান না। বরাবরের মতো মধ্যস্বত্বভোগীরাই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়। সনাতন বাজারব্যবস্থায় কৃষকের এই বঞ্চনার ইতিহাসও নতুন নয়। বাজারের এই অবস্থার জন্য বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে। কৃষক যাতে ফসল সংরক্ষণ করে চাহিদা অনুযায়ী বিক্রি করতে পারে সেজন্য ‘কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জোরদারকরণ প্রকল্প’ নামে একটি কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়েছে। এটি চলবে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত নরসিংদী, কুমিল্লা, ভোলাসহ ৩৫টি জেলার ৬৬ উপজেলায় ৩২৫টি জিরো কুলিং চেম্বার স্থাপন করা হয়েছে। ৩ হাজার কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের উপ প্রকল্প পরিচালক, তৌহিদ মো. রাশেদ খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কৃষকরা যাতে নিজেরাই টমেটো, বেগুন, শিম, শসা, ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন ফসল সংরক্ষণ করতে পারেন সেজন্য জিরো কুলিং চেম্বার তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। এ চেম্বারে সবজি প্রকারভেদে ১২০ থেকে ১৫০ কেজি পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এগুলো ৪ থেকে ৫ দিন, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১২ দিন পর্যন্ত একই মান থাকে। এসব চেম্বারে পণ্য সংরক্ষণ করে কৃষকরা চাহিদা অনুযায়ী বিক্রি করতে পারে। তাতে করে বাজারব্যবস্থায় একটি প্রভাব সৃষ্টি করা সম্ভব। কৃষকদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিত করতে কী ধরনের ব্যবস্থা নেবেন তা জানতে চাইলে নবনিযুক্ত কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুস শহীদ বলেন, এক্ষেত্রে বাজারকে প্রাধান্য দিতে হবে। সেখানে দেখতে হবে চাহিদা কেমন আছে।
চাহিদার চেয়ে জোগান কম থাকলে দাম বাড়বে। আবার সরবরাহ সঠিকভাবে না হলে জোগান পর্যাপ্ত থাকলেও কোনো সমাধান হবে না। এক্ষেত্রে দুটির মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে বলব, আপনারা কোন জেলায়, কোন স্থানে কী কী সমস্যা আছে- তা চিহ্নিত করুন। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি নতুন হলেও এখানে তো অভিজ্ঞ জনশক্তি রয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, আমাকে সময় দিতে হবে। আশা করি ভালো একটি অবস্থা সৃষ্টি করা যাবে। কৃষক তার ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবে। আর সঠিক মূল্য না পেলে তো উৎপাদনে কৃষক মনোযোগী হবে না। তাতে করে পণ্য আমদানি করতে হবে। এর জন্য কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে কাজ করা হবে। কৃষি অর্থনীতিবিদরা কৃষকের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার জন্য মূলত কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে দায়ী করেছেন।