পবিত্র মাহে রমজান সমাগত। সারা দিন পানাহারে বিরত থেকে সিয়াম সাধনার পর ইফতারে খেজুর মুখে দেন প্রায় সবাই। রোজার আগে আবারও উত্তাপ ছড়াচ্ছে খেজুর আর ছোলার দাম। গেল বছরের তুলনায় ছোলার দর বেড়েছে কেজিতে অন্তত ৩০ টাকা। আগের বছরের তুলনায় আমদানি কম হওয়ায় রমজানকে কেন্দ্র করে খেজুরের দাম বাড়ছে। চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে মানভেদে খেজুরের দাম কেজিতে বেড়েছে দুই থেকে তিনগুণ। গুটিকয়েক ব্যবসায়ীকে ইমপোর্টের অনুমতি দেয়ায় এ দাম বৃদ্ধি বলে দাবি আমদানিকারকদের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি না বাড়লে সামনের দিনগুলোতে ইফতারের অন্যতম খাবার খেজুরের দাম আরো বেড়ে যেতে পারে। ইফতারে ফলটি মুখে দেওয়া সুন্নত। সে কারণেই রমজান মাসে বাংলাদেশে খেজুরের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। বাংলাদেশে যেহেতু সুস্বাদু খেজুর হয় না, তাই সবই আমদানি করতে হয়। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসে প্রায় ২০ ধরনের খেজুর। তবে দাম এবার বেশ চড়া। গত বছরের চেয়ে এবার ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়েছে কেজিতে। ইফতারিতে খেজুর না থাকলে যেন টেবিলে পরিপূর্ণতা আসে না। খেজুর খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি খুবই পুষ্টিকর খাবার। খেজুরকে প্রাকৃতিক শক্তির উৎস বলা হয়। ভিটামিন, আঁশ, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও জিঙ্কসমৃদ্ধ খেজুর একজন সুস্থ মানুষের শরীরে আয়রনের চাহিদার প্রায় ১১ ভাগই পূরণ করে। রোজার সময় ইফতারিতে খেজুর রাখা ভালো। এ ছাড়া অন্য সময়ে প্রতিদিন সকালে ৩-৪টি খেজুর খেলে দারুণ উপকার পাওয়া যায়। বিশেষত যারা কোনো ধরনের পেটের রোগে ভুগছেন, তাদের জন্য তো ফলটি মহৌষধ। এদিকে পবিত্র রমজান সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় আট খাদ্যপণ্য বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে রমজান মাসে যাতে এসব পণ্যের কোনো ঘাটতি না হয়, সে জন্য এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। খাদ্যপণ্যগুলো হচ্ছে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, এসব পণ্য ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানি করা যাবে। এই সুবিধায় আমদানির সুযোগ থাকবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। আগে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য এই সুযোগ দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাহারি জাতের খেজুরের আবাদ হয় মধ্যপ্রাচ্যে। তবে ভোক্তা বিবেচনায় ব্যবসায়ীরা পসরা বসিয়েছেন বাংলাদেশেও। এখানে সারা বছর ১ লাখ টন চাহিদা রয়েছে। তবে শুধু রমজানেই প্রয়োজন হয় ৪০ হাজার টন। মুসলিমদের সিয়াম সাধনার মাসে রোজাদারদের খাদ্যতালিকায় থাকে ছোলাও। যার বাৎসরিক চাহিদার প্রায় অর্ধেক লাগে এই মাসেই। ইফতারে খেজুর আর ছোলা সরবরাহ করে ব্যবসায়ীরা খান লাভের গুড়। তবে আমদানিনির্ভর পণ্য দুটির দামের উত্তাপ ছড়াচ্ছে রোজার আগেই। জানা যায়, শুল্কায়ন নিয়ে কড়াকড়ি আরোপের পর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খেজুর আমদানি কমেছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে খেজুর আমদানি হয়েছিল ৩০ হাজার ৯১১ মেট্রিক টন। চলতি অর্থবছর একই সময়ে খেজুর আমদানি হয়েছে ১২ হাজার ৯৯০ মেট্রিক টন। এই হিসেবে খেজুর আমদানি কমেছে ১৭ হাজার ৯২১ মেট্রিক টন। যার প্রভাব পড়েছে দামে। উদ্ভিদ সংঘ নিরোধ চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর ৮৪ হাজার ১৫১ মেট্রিক টন খেজুর আমদানি হয়। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের ছয় মাস ২০ দিনে আমদানি হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৯৯০ মেট্রিক টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ মেট্রিক টন। যার পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে রমজানে খেজুরের চাহিদা থাকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন। অতীতে রমজানকে ঘিরে আগেই চাহিদা অনুযায়ী খেজুর আমদানি করতেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এবার শুল্কায়ন নিয়ে কড়াকড়ি আরোপের পর খেজুর আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। খেজুর আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে খেজুর আমদানি একেবারেই হয়নি। পাঁচ মাসে খেজুর আমদানি হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৩৬৪ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ডিসেম্বর মাসে খেজুর আমদানি বেড়েছে। ওই মাসে খেজুর আমদানি হয়েছে ৬ হাজার ১৬ মেট্রিক টন। চলতি মাসের গত ২০ দিনে আমদানি হয়েছে ৬১০ মেট্রিক টন। খেজুর আমদানি কমে যাওয়ার পাশাপাশি শুল্কায়ন বেশি হওয়ায় এখন বাজারে খেজুরের দাম বাড়তি। চট্টগ্রামের খেজুরের পাইকারি বাজার ফলমণ্ডিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে গত রমজানের আগে যে আজওয়া খেজুর বিক্রি হতো ৮০০ টাকায়, সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার টাকায়। অন্যদিকে মরিয়ম খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। মেডজুল খেজুরও একই দামে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। কম দামের জিহাদি খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়, যে খেজুর আগে বিক্রি হতো ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। প্রসঙ্গত, আগে কম দামের খেজুরের দামেই শুল্কায়ন হতো উন্নতমানের খেজুর। এতে রাজস্ব হারাত সরকার। বিষয়টি নিয়ে লেখালেখির পর খেজুরের শুল্কায়নে নতুন নিয়ম চালু করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। গত বছরের ৩ এপ্রিল চালু করা নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এখন থেকে খেজুরের মানের ওপর ভিত্তি করে শুল্কায়ন মূল্য নির্ধারণ করা হবে। এক্ষেত্রে প্রিমিয়াম গ্রেড (উন্নতমানের) খেজুর প্রতি কেজি চার ডলার, মিডিয়াম গ্রেডের (মাঝারি মানের) খেজুর প্রতি কেজি দুই ডলার এবং লোয়েস্ট গ্রেড (নিম্নমানের) খেজুর প্রতি কেজি এক ডলার করে শুল্কায়ন করা হবে।
তবে ফল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরবরাহ ভালো থাকলেও চড়া দামে আমদানি করায় বাড়তি মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, গেল বছরের তুলনায় ছোলার দাম বেড়েছে কেজিতে অন্তত ৩০ টাকা। আর খেুজরের ৫০ টাকা। এক বিক্রেতা বলেন, এখন প্রতি কেজি খোলা খেজুর বিক্রি করছি ২০০ টাকায়। ২০২৩ সালে তা ছিল ১৪০ টাকা। আরেক বিক্রেতা বলেন, বর্তমানে কেজিপ্রতি ছোলা বেচছি ১১০ টাকায়। গত বছর তা ছিল ৭০ টাকা। বছর না ঘুরতেই দামের উলম্ফগতির জন্য দায়ী আমদানিকারকদের সিন্ডিকেট। গুটিকয়েক ব্যবসায়ীকে ইমপোর্টের অনুমতি দেয়ায় এই দাম বৃদ্ধি বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।