আখের গুড়ে কোটি টাকার বাজার
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিয়ান স্ট্যালিন
শহর-গ্রাম সর্বত্রই গুড়ের চাহিদা রয়েছে। শীতকালেই আখের রস জ্বালিয়ে তৈরি করা হয় গুড়। কোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার না করায় এ গুড় নরম হয়। চুলার ওপর টগবগ করে ফুটছে আখের রস। পাশাপাশি রয়েছে ছয়টি চুলা। রস লাল হয়ে এলে এক চুলা থেকে চলে যাচ্ছে আরেক চুলায়। এভাবেই তৈরি হচ্ছে আখের গুড়। এ চিত্র পাড়াগাঁয়ের এক একটি কারখানার। প্রায় বহুবছর ধরে নিজস্ব কারাখানাগুলোয় গুড় তৈরি করা হচ্ছে। ঋতু পরিবর্তনের শুরুতেই ধীরে ধীরে বাড়ছে শীতের আমেজ। সেইসাথে শীত এলেই শুরু হয়ে যায় পিঠাণ্ডপুলির মহোৎসব।
পিঠা উৎসবে আখের গুড়ের যেন জুড়ি নেই। শীতের হিমেল বাতাস বইতে না বইতেই গুড় তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আখ চাষিরা। আর শীতের মৌসুম এলেই শুরু হয়ে যায় সুস্বাদু আখের গুড় তৈরির কাজ। একদিকে আখ কেটে সংগ্রহ করা হচ্ছে, অন্যদিকে কেটে আনা আখ থেকে মেশিনের মাধ্যমে রস সংগ্রহ করে সেই রস জাল দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে গুড়। এরই মধ্যে এ গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন উল্লাপাড়ার আখ চাষিরা। জানা যায়, শীত মানেই বাঙালির পিঠা-পুলির উৎসব। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুরুল ইউনিয়নে পাটধারী এবং চড়িয়া শিকার গ্রামের মাঠে দেখা যায় আখের গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন আখ চাষিরা।
দীর্ঘ ২ বছর ধরে এই এলাকায় প্রতি শীত মৌসুমে আখ থেকে গুড় তৈরি করতে দেখা যায়। তবে আগের মতো আখ চাষ না থাকায় তেমন একটা চোখে পড়ে না রস থেকে গুড় তৈরি করার দৃশ্য। সরেজমিন দেখা যায়, গ্রামের নারী-পুরুষ, কিশোররা আখ থেকে পাতা ও আগা বাদ দিয়ে শুধু আখ বের করে আলাদা করে রাখছেন। আর পাতা ও আগার অংশটুক নিয়ে যাচ্ছে বাড়িতে গৃহ পালিত পশু গরু-ছাগলের খাবার হিসেবে। তারপর সেই আখগুলো থেকে কারিগররা একটি মেশিনের মাধ্যমে রস বের করছে। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার খন্দকবাড়িয়া গ্রামে ১ বিঘা জমির উপর আখের গুড়ের কারখানাটির অবস্থান। ওই গ্রামের দুই ভাই রেজাউল ইসলাম ও মিজানুর রহমান কারখানার মালিক। তারা নিজেরাই গুড় তৈরি করেন। তাদের বাবা কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ কারখানার গুড় এলাকার লোকজন পিঠা-পায়েস, সেমাই-সুজিসহ মিষ্টি খাবার তৈরিতে ব্যবহার করেন। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এ কারখানায় গুড় তৈরি করা হয়। প্রতি ১০ কেজি আখ থেকে ১ কেজি গুড় পাওয়া যায়। প্রতি কেজি আখের দাম ৪ টাকা। এ হিসাবে ১ কেজি গুড় তৈরি করতে ৪০ টাকার আখ প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া শ্যালো মেশিনের খরচ, মজুরি খরচ মিলিয়ে ৬০ টাকা ব্যয় হয় ১ কেজি গুড় তৈরিতে, বাজারে যার দাম ৮০ টাকা।
মৌসুমের জন্য আখের দাম কেজিপ্রতি ১ টাকা করে বাড়িয়েছে সরকার। তাতে চিনি কলগুলোর কাছে মণপ্রতি ২২০ টাকা দরে আখ বিক্রি করতে পারবেন কৃষকরা। তবে এই দাম বাড়া পর্যাপ্ত নয় বলে দাবি করেছেন অনেক কৃষক। অন্যদিকে এক বছরের মধ্যে আখের দাম কেজিপ্রতি ১ টাকা বাড়ানো হলেও এই সময়ে সরকারি চিনিকলগুলোতে উৎপাদিত চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় ২৬ টাকা। আখ চাষিরা বলেছেন, তারা আখের উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দাম পাচ্ছেন। ২০২৩-২৪ মাড়াই মৌসুমের জন্য আখের দাম কুইন্টালপ্রতি ১০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। তাতে প্রতি কেজি আখের দাম বেড়েছে ১ টাকা করে। ফলে আগামী মাড়াই মৌসুমে কৃষক মিলগেটে প্রতি মণ আখ ২২০ টাকা ও বহিঃ কেন্দ্রে প্রতি মণ আখ ২১৬ টাকা দরে বিক্রি করতে পারবেন। অন্যদিকে এর পরের মৌসুম অর্থাৎ ২০২৪-২৫ মাড়াই মৌসুমের জন্যও আখের আগাম দাম ঘোষণা করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
তাতে মিলগেটে প্রতি মণ আখের দাম ২২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪০ টাকা করার কথা জানানো হয়েছে। আখের সংগ্রহ বাড়াতে সর্বশেষ ২০২২-২৩ মাড়াই মৌসুমে প্রতি মণ আখের দাম ৪০ টাকা বাড়িয়ে ১৮০ টাকা বা কুইন্টালপ্রতি ৪৫০ টাকা করেছিল বিএসএফআইসি। আগামী মৌসুমের জন্য তা আরও ৪০ টাকা বাড়িয়ে মণপ্রতি ২২০ টাকা করা হয়েছে। এতে প্রতি কেজি আখের দাম বেড়েছে ১ টাকা করে। অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে মিলগেট থেকে ৭৪ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি করেছিল চিনিকলগুলো। চলতি অর্থবছরে মিলগেটে চিনি বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ, এক বছরে মিলগেটে চিনির দাম বেড়েছে ২৬ টাকা। কৃষক তাদের উৎপাদিত আখের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ আখ চাষি ইউনিয়নের জাতীয় কমিটির সভাপতি আনসার আলী। তিনি বলেন, এক মণ (৪০ কেজি) আখ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কেজি চিনি, ১৪ কেজি ছোবড়া, ৬ কেজি চিটা গুড় ও ২ কেজি প্রেসমাড উৎপাদিত হয়। এসব পণ্য বিক্রি করে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করে চিনিকলগুলো। অথচ কৃষকরা অনেক কম দাম পান। বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর, কালাছড়া, দুলালপুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা মহিষ দিয়ে আখ মাড়াইয়ের কাজ করছেন। দিনভর আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে রস সংগ্রহের পর রাতে সেই রস চুলায় জ্বাল দেওয়া হয়। ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় জ্বাল দেওয়ার পর তৈরি হয় সুস্বাদু লালি। এখনো প্রাচীন পদ্ধতিতে মহিষ দিয়ে মাড়াই করে আখের রস সংগ্রহ করা হয়।
প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে লালি তৈরির কাজ। প্রতি কেজি লালি পাইকারদের কাছে বিক্রি হয় ১২০ থেকে ১৩০ টাকা দরে। জেলার কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে বিজয়নগর উপজেলায় ২৫ হেক্টর জমিতে আখের চাষ হয়েছে। এসব জমিতে ২ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন আখ উৎপাদন হবে। বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের কৃষক মো. রমজান। তিনি ১০ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছেন। তিনি বলেন, প্রতি বিঘা জমিতে যে আখ হয় তা থেকে লালি তৈরি হয় ৪০০ কেজি, যা তিনি বিক্রি করেন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। এতে সব খরচ বাদ দিয়ে তার লাভ হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।
পরপর ১টি বিশাল উনুন তৈরি করে তার উপর চাপানো হয়েছে বিশাল মাপের লোহার কড়াই। তাতেই আখের রস ঢেলে জ্বাল দিচ্ছে। আর অনবরত সেই কড়াইয়ের দিকে সজাগ নজর গুড় কারিগরদের। এসময় কারিগররা প্রায় ২ থেকে ৩ ঘন্টা রস জ্বাল করে। পরে তা চুলা থেকে নামিয়ে ২০ থেকে ২৫ মিনিট রাখার পর শক্ত হয়। পরে কারিগরদের হাতের সাহায্যে শক্ত গুড়গুলোকে একটি নিদিষ্ট আকার দেওয়া হয়।
এভাবেই তৈরি করা হয় আখের রস থেকে সুস্বাদু গুড়। শীতে খেজুরের রসের পাশাপাশি আরেকটা জিনিস সবাইকে আকর্ষণ করে- তা হলো সুস্বাদু আখের লালি। গাঢ় তরল গুড়।
স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় লালি। ঘরে ঘরে লালি দিয়ে তৈরি পিঠা-পুলি শীতের আমেজ ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায়। কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যানমতে, চলতি শীত মৌসুমে শুধু বিজয়নগর থেকে প্রায় ৭৫ দশমিক ২ মেট্রিক টন লালি বিক্রি হবে যার বাজারমূল্য প্রায় সোয়া কোটি টাকা। মুখরোচক পিঠা-পুলি ও পায়েস তৈরিতেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় লালি। এছাড়া চিড়া-মুড়ির সঙ্গে খেতেও অনন্য। শীত মৌসুমেই লালি তৈরি করে স্থানীয় কৃষক পরিবারগুলো। বছরের চার মাস লালি তৈরি করে বাড়তি টাকা আয় করেন তারা।