প্লাস্টিকের বাজার বাড়ছে
প্লাস্টিক পণ্যে বিপ্লব বাংলাদেশে
প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিয়ান স্ট্যালিন
প্লাস্টিক। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অপরিহার্য অংশগুলোর একটি। প্লাস্টিকজাত পণ্য ছাড়া জীবন অচল। বিভিন্ন আকার ও সহজলভ্য এবং কম খরচে হাতের কাছে সহজে পাওয়া যাওয়া কারণে প্লাস্টিকজাত পণ্যের ব্যবহার প্রতিদিনই বাড়ছে। সারা বিশ্বে দ্রুত বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন গৃহস্থালি সামগ্রী তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিক দিয়ে। যেমন- চেয়ার, টেবিল, আলমারি ইত্যাদি। এছাড়া প্লাস্টিক পানির বোতল, কোমল পানীয়ের বোতল, খাবারের প্যাকেট বা মোড়ক হিসেবে প্লাস্টিকজাত পণ্যের জয়জয়কার। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে ৮৫ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। বর্তমান এ শিল্পখাত ১ বিলিয়ন ডলারের (সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা) প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণভাবেও বর্তমানে দেশের প্রতিটি মানুষ গড়ে পাঁচণ্ডসাত কেজি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করছে। কিন্তু ১০ বছর পর তা সাত গুণ বেড়ে দাঁড়াবে ৩৫ থেকে ৪০ কেজিতে। ৫০ দশকের শুরুতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে প্লাস্টিক শিল্প। ৯০ দশক পর্যন্ত এ দেশে নিম্নমানের প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদিত হতো। বিদেশি প্লাস্টিক পণ্যের জন্য দেশীয় বাজার ছিল অবারিত। এখন মানে ও বৈচিত্র্যে বাংলাদেশের প্লাস্টিক শিল্প এতোটাই এগিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশে দেশের তৈরি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। চীন, ভারতেও তা সমাদৃত হচ্ছে। এ শিল্পের উদ্যোক্তারা ২০২১ সাল নাগাদ রপ্তানি বাবদ ২০ হাজার কোটি টাকা আয়ের আশা করছেন। প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হয়। তবে প্রথম থেকেই দুটি শর্ত রাখা হয়। যেমন প্লাস্টিক দ্রব্য উৎপাদনের কোনো পর্যায়েই ডিউটি ড্র-ব্যাক সুবিধা নেয়া যাবে না। এছাড়া রপ্তানির বিপরীতে বন্ড-সুবিধাপ্রাপ্ত এবং ইপিজেড এলাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানের জন্য এ সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। এসব শর্তের কারণে নগদ সহায়তার সুবিধা খুব বেশি পাচ্ছেন না রপ্তানিকারকেরা। আগে শুধু ঘরের টুকিটাকি কাজে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হলেও এখন প্রযুক্তির উন্নয়নে নিত্যপণ্যের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। পোশাক খাতের সরঞ্জাম, খেলনা সামগ্রী, ঘরে ব্যবহারের বিভিন্ন তৈজসপত্র, অফিসে ব্যবহারের জিনিসপত্র, গৃহনির্মাণসামগ্রী, জানালা ও দরজা, চিকিৎসার উপকরণ, কৃষি খাতের জন্য পাইপ ও বড় চৌবাচ্চা, গাড়ি ও সাইকেলের যন্ত্রাংশ, পোলট্রি ও মৎস্য খাতের বিভিন্ন পণ্য, কম্পিউটারের উপকরণ হিসেবে প্লাস্টিকের পণ্য তৈরি হচ্ছে। ফলে আমদানিনির্ভর শিল্পটি এখন রপ্তানিমুখী শিল্পে পরিণত হয়েছে। দেশে প্লাস্টিক শিল্পের যাত্রা শুরু সেই ৫০ দশকের শুরুতে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এ শিল্প এতটাই এগিয়েছে যে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১২তম প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমই) সূত্রে জানা গেছে, এ মুহূর্তে দেশে ছোট-বড় প্রায় ৫ হাজার প্লাস্টিক শিল্প রয়েছে। এ খাতে সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৫ লাখ মানুষের। পরোক্ষভাবে আরো প্রায় ১৩ লাখ মানুষ কাজ করছে। এখানে ১৮ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। যার ৬৫ শতাংশ ঢাকার মধ্যে, ২০ শতাংশ চট্টগ্রাম, ১০ শতাংশ নারায়ণগঞ্জ ও বাকি ৫ শতাংশ অন্য বিভাগে রয়েছে। প্লাস্টিক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) রপ্তানি বাড়ার কারণেই এ খাতের রপ্তানি আয় ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। আর জিএসপি সুবিধা স্থগিত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্লাস্টিক শিল্প। বর্তমানে প্লাস্টিক পণ্যের মোট রপ্তানির ৭০ শতাংশই ইইউতে ও আমেরিকায় হয় ১০ শতাংশ। তবে আমেরিকা বাংলাদেশের জন্য ছিল সম্ভাবনাময় বাজার। সেজন্য দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুতিও নিতে থাকে। তবে এখন সেটিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। কারণ, জিএসপি স্থগিতের কারণে ৩ থেকে ১৬ শতাংশ শুল্ক দিয়ে রপ্তানি করতে হচ্ছে। এদিকে, জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক (এসক্যাপ) কয়েক বছর আগে গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশের প্লাস্টিক শিল্প খুবই সম্ভাবনাময়। ২০২০ সালের মধ্যে এ খাতের রপ্তানি আয় ৪০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে। বিপিজিএমইএ জানায়, বর্তমানে ২০টি বড় প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি করছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, স্পেন, কানাডাসহ বিশ্বের ২৩টি দেশে সরাসরি যাচ্ছে বাংলাদেশের এই পণ্য। সার্কভুক্ত ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে দেশে ছোট-বড় মিলে ৫ হাজার কারখানায় প্রায় ১৫ ক্যাটাগরিতে পণ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে পোশাক খাতের জন্য পলিব্যাগ, হ্যাঙ্গার, প্লাস্টিক ক্লিপ, বোতাম, খেলনা সামগ্রীর মধ্যে পুতুল, বল, গৃহে ব্যবহারের জন্য চেয়ার, টেবিল, ডাইনিং টেবিল, বিভিন্ন ধরনের রেক, ঝুড়ি, বাথটাব, জগ, মগ, ঝুড়ি; অফিসে ব্যবহারের জন্য পেপারওয়েট, স্কেল, টেবিল, বলপেন, ফাইল কভার অন্যতম। কৃষি খাতের জন্য পাইপ, সাইকেলের যন্ত্রাংশের মধ্যে বাম্পার, হাতলের কভার, ব্যাক লাইট, স্পোক লাইট, মাছ ও ডিম রাখার ঝুড়ি, ভিডিও ও অডিও ক্যাসেট, কম্পিউটারের উপকরণসহ বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরি হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে ৮৫ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্য সামগ্রী রফতানি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমান এ শিল্পখাত ১ বিলিয়ন ডলারের প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী রফতানি করছে বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। দেশের প্রতিটি মানুষ গড়ে ৫-৭ কেজি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করছে। কিন্তু দশ বছর পর তা ৭ গুণ বেড়ে দাঁড়াবে ৩৫ থেকে ৪০ কেজিতে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, দেশের প্লাস্টিকশিল্পের বাজার এখন ৪০ হাজার কোটি টাকার।