একটি বায়িং হাউসে ২২ বছর আগে মাত্র ৩ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন মোস্তাফিজ উদ্দিন। বর্তমানে রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের সফল উদ্যোক্তা। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেডে তার গড়া ডেনিম এক্সপার্ট নামের কারখানা থেকে মাসে গড়ে ১৫ কোটি টাকার ডেনিম পোশাক রপ্তানি হয়। কারখানার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে ৭ বছর ধরে সফলভাবে আয়োজন করছেন আন্তর্জাতিক মানের প্রদর্শনী ডেনিম এক্সপো। নিজের প্রতিষ্ঠানের নামের মতোই মোস্তাফিজ সত্যিকারের ডেনিম বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। এই মোস্তাফিজ উদ্দিনকে নিয়েই বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যম বিবিসি ‘ট্রু কস্ট অব অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রিজ’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র প্রচার করেছে। সেখানে তার করোনাকালের সংগ্রাম তুলে ধরেছেন গণমাধ্যমটির প্রতিবেদক জেন কোপেসটেক। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) শীর্ষ ডেনিম সরবরাহকারী হওয়ায় বিশ্ববাজারে আরও বেশি রপ্তানির জন্য এই খাতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ইইউয়ে শীর্ষ ডেনিম রপ্তানিকারক দেশ। এই অঞ্চলে প্রতি তিনজনের একজন বাংলাদেশে উৎপাদিত ডেনিম প্যান্ট পরেন। তবে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সাড়ে ৬৪ বিলিয়ন ডলারের ডেনিমের বিশ্ববাজারে আধিপত্য বিস্তারে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। বর্তমানে স্থানীয় রপ্তানিকারকরা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের ডেনিম পণ্য সরবরাহ করছেন। ২০২৬ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ডেনিমের বাজার ৭৬ দশমিক এক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি বছরে চার দশমিক আট শতাংশ হারে বাড়বে। স্থানীয় উদ্যোক্তারা ডেনিম খাতে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। দেশে ইতোমধ্যে ৪২টি আধুনিক কারখানা আছে।
এ থেকে প্রতি বছর ৯০ কোটি মিটারের বেশি ডেনিম কাপড় উৎপাদন সম্ভব। প্রায় একদশক আগেও ১২টি কারখানায় ডেনিম উৎপাদনে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার কোটি টাকা। তবে গত কয়েক বছরে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ডেনিম সরবরাহে বাংলাদেশ প্রতিবেশী চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুসারে, আগামী ৫ বছরে ৭০ কোটি ডলারের ডেনিম রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে হবিগঞ্জে দুটি কারখানার জন্য দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ভারত, জাপান, চীন, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশি ডেনিমের ক্রমবর্ধমান গন্তব্যস্থল। ডেনিম বা এর থেকে তৈরি জিনস। চাহিদার বিবেচনায় এর ধারেকাছে নেই অন্য কোনো পোশাক। আবার চলতি ট্রেন্ড থেকে শুরু করে ক্ল্যাসিক, রেট্রো, স্ট্রিট, আরবান, ক্যাজুয়াল, নিউ নরমাল পর্যন্ত প্রায় সব ধারাতেই এই পোশাকের উপস্থিতি সর্বত্র। বলা হয়, গত অর্ধশতাব্দীতে ডেনিমে তৈরি পোশাকের চাহিদা বিন্দুমাত্র কমেনি। ফ্যাশন দুনিয়ায় ডেনিম নিয়ে একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে: ডেনিম ইজ অলওয়েজ আ গুড আইডিয়া। কারণ, যেকোনো পরিবেশ, ঋতু বা আয়োজন সব জায়গায় ডেনিম মানানসই। তবে সহজভাবে বললে এর জনপ্রিয়তার মূল কারণ এর বৈচিত্র্য। আর এই বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তুলতে ডেনিম প্রস্তুতকারকেরা বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করেন। যেমন ওয়াশ। ডেনিম বা জিনস ডিজাইনে ওয়াশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ধরনের ওয়াশিংয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় ট্রেন্ডি ডিজাইন। এই ওয়াশিংয়ের আবার রয়েছে কয়েকটি ধাপ। যেমন এক ধাপে শুধু কাপড় পরিষ্কার করা হয়, অন্য ধাপে ডায়িংয়ের মাধ্যমে ডেনিমের রং নির্ধারণ করা হয়। আবার শুধু ডিজাইন করার জন্যও ওয়াশ ব্যবহার করা হয়। ওয়াশ সাধারণত তিন ধরনের- নেচারাল, অ্যাসিড ও বায়ো পলিশিং। এবং এই ওয়াশের রয়েছে অনেকগুলো প্রক্রিয়া। তবে পুরো বিশ্বে ড্রাই ও উইট- এই দুটি প্রক্রিয়া বেশি জনপ্রিয়। ফ্যাশনে ডেনিমের আবির্ভাব গত শতকের পঞ্চাশের দশকে, ঠিক যখন লেদার জ্যাকেটের আবির্ভাব হয়। সেই তখন থেকে ডেনিম হয়ে আছে ‘টেনিউরড ট্রেন্ড’। একটা সময় ছিল যখন ডেনিম বলতেই সবাই বুঝতেন জিনস। এখনো সবাই এই একটা জায়গায় এসে গোলমাল পাকিয়ে ফেলেন। জিনস হচ্ছে ডেনিম ফেব্রিক থেকে বানানো প্যান্ট। ব্যাপারটা অনেকটা ‘সব জিনসই ডেনিম, কিন্তু সব ডেনিম জিনস নয়’-এর মতো। তাই কখনো জিনসের শার্ট, জ্যাকেট হয় না। সব ডেনিমের শার্ট, জ্যাকেট। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ইইউতে সাড়ে ৮৮ কোটি ডলারের ডেনিম রপ্তানি করেছে।’ ২০২২ সালে ইইউয়ে ডেনিম চালান থেকে আয় হয়েছে এক দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। এমনকি, ২০২০ সালের করোনা মহামারির বছরেও বাংলাদেশ থেকে ইইউয়ে ডেনিম রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার। একইভাবে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রেও ডেনিম রপ্তানি বেড়েছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৫৫ কোটি ৬০ লাখ ৮০ হাজার ডলারের ডেনিম রপ্তানি করেছিল। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ডেনিম জিন্স সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভীর বলেন, ‘২০২৩ সালের তুলনায় এ বছর ডেনিম উৎপাদন ১২ শতাংশের বেশি বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।’
তিনি জানান, চলতি বছরে ডেনিমের চাহিদা গত বছরের তুলনায় ভালো। এ বছর এর রপ্তানি বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ফ্যাশনে পরিবর্তন এবং ডেনিম আরো নরম ও আরামদায়ক হওয়ায় বিশ্বব্যাপী এর চাহিদা বাড়ছে। বিটিএমএ’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনসুর আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে ডেনিম খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ আছে।’