ভোজনরসিক বাঙালির বিরাট এক অংশের ভীষণ পছন্দের খাবার শুঁটকি। লবণ মাখিয়ে রোদে শুকিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা এই শুঁটকি খেতে দারুণ সুস্বাদু। নিঃসন্দেহে এটি প্রোটিনের ভালো উৎস। খাদ্য সংরক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে অনেক পুরোনো একটি পদ্ধতি হচ্ছে রোদে শুকিয়ে খাদ্য সংরক্ষণ। মাছ যখন শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়, তখন তাকে আমরা শুঁটকি মাছ বলে থাকি। মাছ রোদে শুকানো হলে মাছের যে জলীয় অংশ থাকে, তা শুকিয়ে যাওয়ার ফলে মাইক্রো অর্গানিজম জন্মাতে পারে না এবং মাছকে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। শুঁটকি মাছের একটি আলাদা গন্ধ ও স্বাদ রয়েছে। অনেকেই শুঁটকি মাছ খেতে খুবই পছন্দ করেন; অনেকে আবার শুঁটকি মাছের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। কারো কারো কাছে শুঁটকি মাছের ভর্তা ও নানা রকম পদ অত্যন্ত পছন্দনীয়। ভালো মানের সতেজ মাছ কোনো কৃত্রিম প্রিজারভেটিভ ছাড়া শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে শুঁটকি মাছ হয় সম্পূর্ণভাবে একটি প্রাকৃতিক খাবার। শুঁটকি মাছ উচ্চমানের প্রোটিনের ভালো উৎস। এতে প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ প্রোটিন পাওয়া যায়। শুঁটকি মাছের প্রোটিনে যে অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে, তা প্রায় ডিমের অ্যামিনো অ্যাসিডের সঙ্গে তুলনীয়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ২৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫১৪ ডলারের শুঁটকি রপ্তানি হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশ থেকে প্রায় ২৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫১৪ মার্কিন ডলারের সমমূল্যের শুঁটকি রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ২৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ১১০ টাকা হিসাবে)। এর মধ্যে শুধু ডিসেম্বর মাসেই রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ ২৭ হাজার ডলারের সমমূল্যের শুঁটকি। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শুঁটকির বড় অংশই গেছে হংকং, সিঙ্গাপুর, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডে। আসাদগঞ্জের শুঁটকির আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শুঁটকির ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই সরবরাহ করা হয় আসাদগঞ্জ থেকে। আস্ত শুঁটকির পাশাপাশি রপ্তানি হয় মাছের বিভিন্ন অংশবিশেষ কেটে তৈরি করা শুঁটকিও। এর মধ্যে রয়েছে লেজ, পাখনা ও অন্ত্র। এসব শুঁটকি আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে উৎপাদিত মাছের অন্তত ১৫ শতাংশ শুকিয়ে শুঁটকিতে রূপান্তর করা হয়। মৎস্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে সমুদ্র উপকূল ও অভ্যন্তরীণ জলাধার থেকে প্রায় ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার টন মৎস্য আহরিত হয়েছে। তার মধ্য থেকে ওই বছর ৭ লাখ টনের বেশি মাছ শুঁটকি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে। দেশে কক্সবাজারের নাজিরারটেক, সোনাদিয়ার চর, মহেশখালী, চট্টগ্রাম নগরের কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকা, আনোয়ারা উপজেলা, সুন্দরবনের দুবলার চর, সুনামগঞ্জের ইব্রাহীমপুরসহ বিভিন্ন উপকূলবর্তী এলাকায় শুঁটকি তৈরি করা হয়। আশপাশের দেশগুলোতে শুঁটকির দাম কম। ফলে বাংলাদেশ থেকে শুঁটকি রপ্তানি কমেছে। দেশে কাঁচা মাছের দাম বেশি হওয়ায় শুঁটকির দামও বেশি। তবে গুণগত মানের কারণে দেশীয় শুঁটকির চাহিদা রয়েছে বিদেশে। ২০১২-১৩ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর- এই ১১ বছরে প্রায় ৭ কোটি ১৭ লাখ ১৯ হাজার ২৬৩ ডলারের শুঁটকি রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। সেই হিসাবে বছরে গড়ে প্রায় ৬৫ লাখ ২০ হাজার ডলারের শুঁটকি রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। ওই বছর প্রায় ৮৬ লাখ ৬৫১ ডলারের শুঁটকি রপ্তানি হয়েছিল। আর উল্লেখিত বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম হয়েছিল ২০১৫-১৬ অর্থবছরে, প্রায় ৪২ লাখ ৫০ হাজার ডলারের। দেশে সামুদ্রিক মাছের মধ্যে রূপচাঁদা, ফাইস্যা, ছুরি, সুরমা, লইট্টা, চিংড়ি, ইলিশ, চাপিলা ইত্যাদি মাছের শুঁটকি হয়ে থাকে। মাছভেদে ১ কেজি শুঁটকি তৈরিতে প্রজাতিভেদে আড়াই থেকে ৪ কেজি মাছ প্রয়োজন হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে কাঁচা মাছের দাম বেড়েছে। আর এর প্রভাবে বেড়েছে শুঁটকির দামও। দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে শুঁটকি রপ্তানিতে প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। সুন্দরবনের দুবলার চরে শুঁটকির উৎপাদন বেড়েছে। এই মৌসুমে জেলেরা ৬৫ হাজার কুইন্টাল বা ৬ হাজার ৫০০ টন শুঁটকি উৎপাদন করেছে। বন বিভাগ বলছে, চলতি অর্থবছরে শুঁটকির এই উৎপাদন এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এর আগে কোনো মৌসুমেই সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টনের বেশি শুঁটকি উৎপাদন হয়নি। বরগুনা ও পটুয়াখালী উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় শুঁটকি উৎপাদন মৌসুম শুরু হয়েছে। শুঁটকি তৈরির কাজে দুই জেলায় জেলে, শ্রমিক, ব্যবসায়ী মিলে ৭০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলাসহ বিদেশের মাটিতেও বাঙালির রসনায় এ অঞ্চলের শুঁটকি তৃপ্তি জোগাচ্ছে।
সাধারণত শুঁটকি পল্লিগুলোতে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস ধরে চলে শুঁটকি প্রক্রিয়া জাত করণের কাজ। জেলে, শ্রমিকরা দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। শুঁটকি শ্রমিকরা জানিয়েছেন, নদী থেকে কাঁচা মাছ শুঁটকিপল্লিতে নিয়ে আসার পর নারী শ্রমিকরা সেগুলো পরিষ্কার করেন। এরপর মাছগুলো পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে মাচায় শুঁকানো হয়। তিন-চার দিনের রোদে মাছগুলো শুঁকিয়ে শক্ত হয়। প্রায় ২৫ প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরি করা হয় এখানে। এর মধ্যে রূপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্টা ও পোয়া অন্যতম। এছাড়া চিংড়ি, ভোল, মেদসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছেরও রয়েছে অনেক চাহিদা। এ অঞ্চলের শুঁটকি চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, খুলনা ও জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হয়। প্রস্তুত করার সময় কোনো প্রকার কীটনাশক বা অতিরিক্ত লবণ দেয়া হয় না বলে এ এলাকার শুঁটকির চাহিদা একটু বেশি থাকে। এছাড়া এখানকার শুঁটকি, মাছের গুঁড়ো সারাদেশে পোলট্রি ফার্ম ও ফিস-ফিডের জন্য সরবরাহ হয়ে থাকে। শুঁটকি শ্রমিকরা জানান, আধুনিক পদ্ধতিতে শুঁটকি তৈরি করতে চান। আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি করতে পারলে উৎপাদন আরো বাড়ত; এতে শ্রমিক এবং জেলেদেরও কষ্ট কম হতো, সবাই লাভবান হতো। ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি কেজি ছুরি মাছের শুঁটকি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা, রূপচাঁন্দা ১ হাজার থেকে দেড় হাজার, মাইট্যা ৮০০ থেকে ১ হাজার, লইট্যা ৬০০ থেকে ৭০০, চিংড়ি ৭০০ থেকে ৯০০ এবং অন্যান্য ছোট মাছের শুঁটকি ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হয়। মধ্যপ্রাচ্য, ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ আরো অনেক দেশেই বেসরকারিভাতে নানা মাধ্যমে এখানকার শুঁটকি যাচ্ছে। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের খাদ্য ও বিকিরণ জীববিদ্যা প্রতিষ্ঠানে সীমিত আকারে এ ধরনের খাদ্য সংরক্ষণের ওপর গবেষণা চলছে। ২০০৬-০৭ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা মূল্যের ৭৭ টন শুঁটকি এবং ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ৪৪১ টন লবণে সংরক্ষিত ও চ্যাপা শুঁটকি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। খাদ্য থেকে প্রাপ্ত প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে মৎস্য ও মৎস্যজাত খাদ্য থেকে। দেশের মানুষের বার্ষিক জনপ্রতি মাছের চাহিদা ২০ দশমিক ৪৪ কেজি। চাহিদার বিপরীতে বার্ষিক জনপ্রতি খাদ্য হিসাবে মাছ গ্রহণ ১৮ দশমিক ৯৪ কেজি অর্থাৎ ১ দশমিক ৫০ কেজি ঘাটতি থাকে। এই গ্রহণ করা মাছের প্রায় ৫ শতাংশ আসে শুঁটকি থেকে। বছরে প্রায় ৫ দশমিক ৪৬ লাখ টন মৎস্য আহরিত হয় সমুদ্র থেকে, যার ২০ শতাংশ শুঁটকি হিসেবে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। বাংলাদেশ থেকে ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রায় ৬২৩ টন শুঁটকি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশে ৮ থেকে ১০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে শুঁটকি তৈরি হয়। ১ কেজি শুঁটকি মাছ তৈরিতে প্রজাতিভেদে প্রায় তিন থেকে ৫ কেজি কাঁচা মাছ প্রয়োজন।