এক পাউন্ডের একটা মৌচাক বানাতে মৌমাছিদের কত ফুল থেকে মধু আহরণ করতে হয় জানেন? প্রায় ২০ লাখ ফুল থেকে মধু আহরণ করতে হয়। আর এখন তো শীতের সময়। শর্ষেফুলের হলুদে সেজেছে গ্রামের চারপাশ। এর মধ্যে বসানো হয়েছে শতাধিক মৌবাক্স। এই মৌবাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষিরা। এভাবে মৌমাছি চাষ করে মানিকগঞ্জে বছরে ৭৬ টন মধু সংগ্রহ করা হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এতে অনেকে যেমন লাভবান হন, তেমনি বাড়ছে ফসলের উৎপাদনও। সম্প্রতি এক সকালে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার দীঘি গ্রামে মৌবাক্স বসান বাগেরহাটের মৌচাষি ও মধুসংগ্রহকারী ফয়সাল হোসেন। প্রায় এক মাস ধরে তিনি সেখানে মৌবাক্সগুলো বসিয়ে মধু সংগ্রহ ও বাজারজাত করছেন। মৌবাক্স পরিচর্যাকারী শ্রমিক আবদুল মান্নান ও আবিদ শিকদারকে মৌবাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করতে দেখা গেল। তাঁরা জানালেন, সপ্তাহে এক দিন মৌবাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। প্রতিটি বাক্স থেকে গড়ে দুই কেজি মধু পাওয়া যায়। ১০০ বাক্স থেকে সপ্তাহে ২০০ কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ছবিলাপুর গ্রামে শর্ষেখেতের পাশে মৌচাষের ৭৫টি বাক্স বসিয়েছেন মো. সাইফুল ইসলাম। এ থেকে তিনি অন্তত ২০ মণ মধু সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা করছেন। তিনি জানান, শর্ষেখেত থেকে মধু আহরণ করলে পরাগায়ণ হয়। এতে শর্ষের উৎপাদন বাড়ে। তাই খেতের মালিকেরাও মৌচাষিদের উৎসাহিত করছেন। শুধু সাইফুল ইসলাম নন, জামালপুরের পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের শর্ষেখেতের পাশে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ চলছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকায় বাক্স বসছে।
পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে হলুদের সমারোহ। গ্রামের মাঠজুড়ে আবাদ হয়েছে শর্ষে। ইতিমধ্যে শর্ষে থেকে মৌমাছির সাহায্যে মধু সংগ্রহ শুরু হয়েছে। মধু সংগ্রহের কারণে শর্ষের ফলনও বাড়ে। শর্ষের ফলন ভালো হওয়ায় মধু সংগ্রহ বাড়বে বলে আশা চাষিদের। দেশে গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন ফুলের মধু উৎপাদন ও সংগ্রহ বেড়েছে প্রায় চার গুণ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মধু উৎপাদন ছিল এক হাজার ৮০৫ মেট্রিক টন, যা গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৩২৮ মেট্রিক টন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই পরিমাণ মধু উৎপাদনের পরও চলতি বছরে এরই মধ্যে বাজারে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অন্যান্য বছর মধু কম উৎপাদিত হওয়ার পরও বাজারে আগের মৌসুমের মধু থেকে যেত। কিন্তু এবার নতুন মৌসুম শুরু হওয়ার পর আগের মধু নেই। মধুর উৎপাদন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারে কী পরিমাণ মধুর চাহিদা রয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে এখন যা উৎপাদন হচ্ছে তার দ্বিগুণ উৎপাদন হলেও বিক্রি হয়ে যাবে। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে বেড়েছে মধু গ্রহণ।
সরকারিভাবে মধু চাষ করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। এই প্রতিষ্ঠানটির সারা দেশে ছয়টি মধু সংগ্রহ কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে প্রশিক্ষিত কর্মীরা সারা বছর মাঠ থেকে নানান ফুলের মধু সংগ্রহ করেন। বিসিকের ছয়টি কেন্দ্র হলো গাজীপুর, দিনাজপুর, বাগেরহাট, বরিশাল, সিলেট ও কুমিল্লা। দেশে সরকারিভাবে একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানটিই মধু সংগ্রহ করে। একই সঙ্গে তারা চাষিদের সঠিকভাবে মধু আহরণে প্রশিক্ষণও দেয়। বিসিক থেকে জানা গেছে, প্রতিবছর মধু উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তার চেয়ে বেশি সংগ্রহ হচ্ছে। যা সম্ভব হয়েছে মধু সংগ্রহকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মধু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ১০০ মেট্রিক টন, কিন্তু সংগ্রহ হয়েছে এক হাজার ৮০৩ মেট্রিক টন। একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ২০০ মেট্রিক টন, উৎপাদন হয়েছে দুই হাজার ৭৬৭ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৩০০ মেট্রিক টন, উৎপাদন হয়েছে চার হাজার ৬২২ মেট্রিক টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাত হাজার ৫০৪ মেট্রিক টন, উৎপাদন হয়েছে ১০ হাজার ৬৫৫ মেট্রিক টন। আর সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাত হাজার মেট্রিক টন, উৎপাদন হয়েছে সাত হাজার ৩২৮ মেট্রিক টন। অন্যদিকে বিসিকের পক্ষ থেকে মধু আহরণ ও উৎপাদনের ওপর প্রতিবছর পাঁচ দিনের একটি মৌচাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। গত পাঁচ বছরে সারা দেশে এক হাজার ৬৯৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, প্রশিক্ষণ নেওয়া এসব লোকজনই বাণিজ্যিকভাবে মাচা বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন। রাজধানীর খুচরা দোকান ও সুপার শপগুলোতে দেখা গেছে, সরিষা, লিচু, বড়ই, ধনিয়া, শজনে ও বিভিন্ন ফুলের মধু রয়েছে। যেগুলো প্রতিকেজি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। অন্যদিকে ভারত, দুবাই, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা মধুও বাজারে রয়েছে। তবে আমদানি করা এসব মধুর দাম দেশীয় মধুর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। কৃষি ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের এক গবেষণা অনুযায়ী, উদ্ভিদের পরাগায়নে মৌমাছির গুরুত্ব অপরিসীম।