ডিলার পর্যায়ে ইউরিয়া, ডিএপি, এমওপি সারের দাম সরকার বেঁধে দিয়েছিল। কত টাকা লাভে এই সার কৃষকদের কাছে পৌঁছাতে হবে, তাও বলা আছে। অথচ সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত বেশি দামে কৃষকদের কাছে বিক্রি করছেন কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা।এটা তো গেল সারের বিষয়। ব্রয়লার মুরগি, ডিম, গম ও ভোজ্য তেলের পর এবার করপোরেট গ্রুপ সিন্ডিকেট করে ধান-চাল মজুদ করছে। এসব প্রতিষ্ঠান স্থানীয় পর্যায়ে বেশি দামে চাল কিনে, অস্থিতিশীল করছে বাজার। এমন বিস্ফোরক তথ্য দিলেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তার মতে, ৬ করপোরেট প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক শর্ত ভঙ্গ করছে। অভিযানেও মজুদদারদের দমানো না গেলে, সাজা দেয়া হবে আমদানির মাধ্যমে। মন্ত্রী জানান, বাজার থেকে চাল কিনে প্যাকেটে ভরে বেশি দামে বিক্রির পদ্ধতি নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা করছে সরকার। চালের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে অভিযোগের তীর বড় মিল মালিক ও করপোরেট কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। গত ২২ জানুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয় করপোরেট কোম্পানিগুলোর মধ্যে সিটি গ্রুপ, স্কয়ার, প্রাণ আরএফএল, মেঘনা গ্রুপ, এসিআই, আকিজ এসেনশিয়ালসহ ৬টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনায় বসে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ওই বৈঠকে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশে বলেন, বাজারে প্রতিযোগিতা করে ধান কেনা থেকে তাদের বিরত থাকতে হবে। অবৈধভাবে বেশি কিনে মজুদ করলে ছাড় দেওয়া হবে না। এ সময় তিনি আরও বলেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যালু অ্যাড করে বাজারে পণ্য বিক্রি করে। সে কারণে তারা বেশি দামে বাজার থেকে ধান কেনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাজার থেকে অল্প পরিমাণ ধান কিনলেও তার প্রভাব পড়ে খুব বেশি। তখন অন্যরাও বেশি দামে ধান কিনতে বাধ্য হয়। এটা বাজারের জন্য অশুভ লক্ষণ। রাজধানীর বাজারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুদৃশ্য প্যাকেটে বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানির চাল যে দামে বিক্রি করা হয়, তার সঙ্গে বাজারে প্রচলিত চালের দামের ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত ব্যবধান রয়েছে প্রতি কেজিতে। এমনকি পোলাওর চালের ক্ষেত্রে ৩০ টাকার বেশি ব্যবধানও দেখা গেছে। এসিআই ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের ৫ কেজির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৪৩০ টাকায় ও ১০ কেজির ৮৬০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম ৮৬ টাকা। প্রাণ কোম্পানির ৫ কেজির নাজিরশাইলের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৪৯০ টাকায়। এতে কেজি পড়ে ৯৮ টাকা। ব্রয়লার মুরগি, ডিম, গম ও ভোজ্য তেলের পর এবার চালের বাজারেও করপোরেট সিন্ডিকেট থাবা গেড়ে বসেছে। নানা কারসাজি করে চালের বাজার অস্থির করে তোলার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। চলতি মাসের শুরুতে প্রতি বস্তায় চালভেদে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে যায়। খুচরা ব্যবসায়ীরা এর জন্য বড় মিলগুলোর সঙ্গে করপোরেট কোম্পানিগুলোকেও দায়ী করেছেন। খাদ্য মন্ত্রণালয় নানা হুঁশিয়ারি দিয়েও এই কারসাজি থামাতে পারছে না। চালের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে খাদ্যমন্ত্রী, খাদ্য সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক করছেন। এমনকি অসাধু ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় এনে জেলে নেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে, কিন্তু তাতে চালের দাম কমছে না। অবশ্য কারসাজির এসব অভিযোগ মেনে নিতে নারাজ করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। তাদের দাবি, অঞ্চলভিত্তিক বড় ব্যবসায়ীরাই চালের বাজারে অস্থিরতার জন্য দায়ী। পোলাওর চালের ক্ষেত্রে দামের পার্থক্য আরও বেশি। বাজারে প্রচলিত ইস্পাহানি কোম্পানির পার্বণ ব্র্যান্ডের এক কেজির প্যাকেটের দাম ১৮০ টাকা। প্রাণের চিনিগুঁড়া ১৭০ টাকা। তীরের চিনিগুঁড়া ১৭৫ টাকা। চাষীর সুগন্ধি চিনিগুঁড়া ১৭৫ টাকা। এফ এম এগ্রো ফুডের চালের কেজি ১৭৫ টাকা। অথচ বাজারে প্রচলিত চিনিগুঁড়া চালের দাম ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। কালিজিরা ১৫০ টাকা কেজি। তা ছাড়া অন্যান্য জাতের পোলাওর চাল ৮০ থেকে ১৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। একই চালের দামে এত হেরফের হওয়ার জন্য দায়ী কারা- এ বিষয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলে তাদের বেশিরভাগই করপোরেট কোম্পানিগুলোর দিকে আঙুল তুলেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারওয়ান বাজারের কিছু ব্যবসায়ী জানান, চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে হলে আগে করপোরেট কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। কেননা তারা বেশি দামে ধান কিনে ও প্যাকেটজাত করে চাল বিক্রি করে। এসব চাল প্রতি কেজি ১৫ থেকে ৩০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হয়। অথচ প্যাকেটের জন্য খরচ হয় মাত্র দুই থেকে আড়াই টাকা। চালের মান কিন্তু একই। এদিকে গত কয়েক দিনে খুচরা পর্যায়ে চালের দাম যে পরিমাণ বেড়েছিল তা এখনও কমেনি। বাড্ডা কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, বিআর২৮ চাল ৫৫ টাকা ও পাইজাম ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। দুই সপ্তাহ দুই আগেও যা ছিল ৪৮ টাকা। কাটারি নাজির বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়, ছিল ৬৬ টাকা। হাসকি নাজির ৫৮ টাকা, আগে ছিল ৫২ টাকা। মিনিকেট ৭০ টাকা, আগের দাম ৬৫ টাকা। জিরা চাল ৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যার কেজি ছিল ৫৮ টাকা। এই বাজারের চাল ব্যবসায়ী রফিক আহমেদ বলেন, সপ্তাহখানেক যাবৎ চালের দাম এই অবস্থায় রয়েছে। কারওয়ান একজন চাল ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চালের বাজার অস্থির করার পেছনের কারিগর হচ্ছে সিটি গ্রুপ, স্কয়ার, প্রাণ আরএফএল, মেঘনা গ্রুপ, এসিআই, আকিজ এসেনশিয়ালসহ বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান। তারা পাইকারি চাল বিক্রির লাইসেন্স পাওয়ার পরই চালের বাজারে কারসাজি শুরু হয়েছে। প্রতি বছরই তারা এই কাজ করে। তারপরও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। সব শাস্তি এসে পড়ে ছোট আড়ত ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে। করপোরেট কোম্পানিগুলো কীভাবে দাম বাড়ায় জানতে চাইলে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, তারা প্রথমে অল্প কিছু দাম বাড়িয়ে বাজার থেকে ধান কিনে নেয়। পরে সেসব ধান গুদামজাত করে। চাল মজুদ করে। যখন খুশি তখন বাজারে ছাড়ে। এতে ছোট ব্যবসায়ীদের কিছুই করার থাকে না। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক উপাচার্য কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, চালের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোই যে এককভাবে দায়ী তা নয়। বরং সেখানে আরও বড় বড় ২০ থেকে ২৫টি অটো রাইস মিলের মালিকরাও দায়ী। এসব অটো রাইস মিল ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মিলেমিশে সিন্ডিকেট বানিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এরা চালের দাম মিলগেটেই বাড়িয়ে দেয়। এর সঙ্গে কিছু ছোট মিলও আছে- বড়রা যখন দাম বাড়ায় তখন তারাও একই দামে বিক্রি করে। করপোরেট ও বড় মিল মালিকরা বাজারটা লুটেপুটে খাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে চালের বাজার স্থিতিশীল হবে না। তিনি আরও বলেন, করপোরেট ও বড় মিল মালিকরা কী দামে ধান কিনছে ও তা চালে পরিণত করতে কেমন খরচ পড়ছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। খরচ অনুযায়ী দাম নির্ধারণের ব্যবস্থা নিতে হবে। অনিয়মকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।