অভাবের সংসারে পড়াটা খুব বেশি দূর এগোয়নি রবিউলের। কলেজের সীমানায় পা পড়ার আগেই সংসারের হাল ধরতে পাড়ি জমান ঢাকায়। ২০০০ সালের দিকে চাকরি নেন একটি হস্তশিল্প কারখানায়। বছর পাঁচেক কাজ করেন সেখানে। পরে বিভিন্ন এনজিওতে কাজ করেছেন। ২০১৩ সালের দিকে নিজেই একটি কারখানা দেন। করোনা মহামারিতে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। পুঁজি হারিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফেরেন শূন্য হাতে। কী করবেন দিশা পাচ্ছিলেন না রেজাউল। দেড় লাখ টাকায় জমি বন্ধক রাখেন। ঢাকায় বন্ধ হয়ে যাওয়া কাজ গ্রামের বাড়িতে বসে শুরু করেন। শুরুতে অনেকে তাচ্ছিল্য করেছিল। কিন্তু রবিউল দমেননি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে নারীদের বোঝালেন। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাদের কারুপণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ দিলেন। প্রশিক্ষণ পাওয়া নারীদের দিয়েই শুরু করলেন হ্যান্ডিক্র্যাফটসের যাত্রা। সবুজ গ্রামবাংলার মোহনীয় ও সুপরিচিত রূপে হৃদয় জুড়িয়ে যায়। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কত অমূল্য সম্পদ, যা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলেছে কুটির শিল্প। একসময় দিনমজুর স্বামী ও সন্তানদের পেটপুরে দুবেলা খাওয়ার কষ্ট হলেও রেনুয়ারা বেগমের এখন আয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। তার হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় সমৃদ্ধ সব কুটির পণ্য, যা বিক্রি করে সংসার চলে, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচও চলে। ময়মনসিংহের গ্রামীণ জনপদের হতদরিদ্র মানুষ হোগলা পাতার তৈরি বাহারি হস্তশিল্প তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। শুধু তাই নয়, এসব পণ্য ইউরোপ, আমেরিকা ও চীনসহ বিশ্বের ৮২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য শত-সহস্র বছর আগের। মানবসভ্যতার ইতিহাস ও ক্রমবিবর্তনের ধারার সঙ্গে মৃৎশিল্পের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ধারা ওঁতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতীয় উপমহাদেশের মৃৎশিল্পের ইতিহাস কমপক্ষে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন। আর বাংলাদেশে মৃৎশিল্পের ইতিহাসও সমৃদ্ধ, বহু প্রাচীন। অথচ দিনের পর দিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্প, হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্প। একসময় এ শিল্পই ছিল অনেকের বেঁচে থাকার সম্বল, রুটি-রোজগারের একমাত্র অবলম্বন। পরিবেশবান্ধব এসব পণ্য যেমন সস্তা ছিল, তেমনি ছিল সৌন্দর্যবর্ধক। একটা সময় ছিল যখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় মেলা, পূজা-পার্বণ প্রভৃতি স্থানে গেলেই চোখে পড়ত বাহারি ও চোখধাঁধানো নানারকম হস্তশিল্পের উপকরণ। যেমন- মাটির কলসি, সানকি, সরা বা ঢাকনা, ছোট-বড় তাগার, হুক্কা, বিভিন্ন রকম পুতুল, দেবদেবীর মূর্তি, গার্হস্থ্য দ্রব্য, মাটির ভাস্কর্য, টালি, শখের হাঁড়ি, মনশাঘট, ফুলদানি ইত্যাদি। আজ আর আগের মতো মেলা, পূজা-পার্বণে এসব মাটির তৈরি জিনিস তেমন একটা চোখে পড়ে না। গুটিকয়েক বিক্রেতাকেই দেখা যায় এসব পণ্য নিয়ে বসতে। আর এখন বড় বড় শহরের কিছু অভিজাত হ্যান্ডিক্রাফটসের শোরুমেই কেবল এসব পণ্যের কিছুটা চোখে পড়ে। কিন্তু কালের বিবর্তনে এই শিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। মানুষ আজ ঝুঁকে পড়েছে এর বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি পরিবেশবিধ্বংসী পণ্যের দিকে। নিত্যব্যবহার্য জিনিস, ঘরের নানারকম আসবাবপত্র ব্যবহারেও মানুষ এখন একরকম বাধ্য হয়েই প্লাস্টিক, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি পণ্য ব্যবহার করছে। ফলে ন্যায্য দাম না পাওয়া, সময়মতো কাঁচামাল না পাওয়া, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকা, স্বল্প সুদের পরিবর্তে চড়া সুদে কঠিন শর্তে ঋণ প্রভৃতি কারণে ঐতিহ্যবাহী এসব শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ফলে অনেকেই আজ বেকার এবং এই শিল্প আজ একরকম বিলুপ্তির পথে। সারা বিশ্বে হস্তশিল্পের আনুমানিক এক হাজার ৭০০ কোটি ডলারেরও বেশি বাজার রয়েছে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন অনেকটা অগোছালোভাবেই সারা দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো প্রদর্শন ব্যবস্থা না থাকায় আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে এসব তৈরি পণ্যের অধিকাংশই পৌঁছায় না।
এছাড়া পণ্যের নকশা, কারুশিল্পীদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য নেই কোনো প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে শণ, বাঁশ ও বেতের চাষ কমে যাওয়ায় কাঁচামালের সংকট প্রকট হচ্ছে। জানা যায়, হস্তশিল্পের আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত, যাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব নকশা উন্নয়ন ও গবেষণা কেন্দ্র আছে। সেখানে বৈশ্বিক গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন করা হয়। আমাদের দেশে হস্তশিল্পের মধ্যে বিভিন্ন রকম বস্ত্র, যেমন- শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, ধুতি, নকশিকাঁথা, মশারি, তোয়ালে, উপজাতীয় বস্ত্র, মসলিন, জামদানি, মলমল টরোয়ো শাড়ি, পাবনার শাড়ি, টাঙ্গাইলের শাড়ি, কাতান, রেশমবস্ত্র, খদ্দর বস্ত্র ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এছাড়া হাতপাখা, মোড়া, সোফাসেট, টেবিলম্যাট, ওয়ালম্যাট, ট্রে, ফুলদানি, শীতলপাটি, ছাইদানি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এগুলোর অনেক পণ্যের ওপরেই আবহমান গ্রামবাংলার প্রকৃতি, রূপ ও সৌন্দর্যকে কারুকাজের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়, যেগুলোর দেশ-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দেশের ভেতরে রয়েছে কারুপণ্য রংপুর, ঢাকা ট্রেড, আস্ক হ্যান্ডিক্রাফটস, কুমুদিনী, আড়ং, নিপুণ ক্রাফটস, ক্রিয়েশন্স সান ট্রেডসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান, যারা হস্তজাত পণ্য রফতানি করছে। বাংলাদেশ হস্তশিল্প প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বাংলাক্রাফট) তথ্যানুযায়ী, শতরঞ্জি, পাটের তৈরি থলে, পাপোশ, টেরাকোটা, বাহারি নকশিকাঁথা, বাঁশ ও বেতের বিভিন্ন সামগ্রী, ঝুড়ি, বেল্ট, চামড়ার তৈরি মুদ্রার বাক্সসহ বিভিন্ন পণ্য রফতানি করছেন এসব উদ্যোক্তা। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক বাজারে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সক্ষমতা থাকলেও বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এগুতে পারছে না। তৃণমূলে অনেক উদ্যোক্তা আছেন। নানা কারণে তারা সামনে এগোতে পারছেন না।
কারখানা অধিদপ্তর থেকে কারখানা স্থাপনে অনুমতি, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) ইত্যাদি পাওয়া আরও সহজ ও ঝামেলা মুক্ত হলে তৃণমূলের উদ্যোক্তারা সাহস পাবেন। উদ্যোক্তার সংখ্যাও বাড়বে। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ ও পর্যবেক্ষণ জরুরি। আগে ২০ শতাংশ ইনসেনটিভ দেওয়া হতো। সেটি কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই ইনসেনটিভ ৩০ শতাংশ। সরকারের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই- জানুয়ারি) এ খাতে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৯ দশমিক ৬১ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে তার আগের বছর ১২ মাসে রপ্তানি হয়েছিল ২০ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ডলার। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে ইউরোপীয় দেশগুলোর চীন বিমুখতা ও ন্যাচারাল পণ্য ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ার কারণে বাংলাদেশের হস্তশিল্পের জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। বর্তমানে ইউরোপেই ৬০ শতাংশ হস্তশিল্প রপ্তানির হয়।