বেশ কয়েকবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট নজর পড়েছে, যা অনেকটা এ রকম- এক শিশু তার মাকে প্রশ্ন করছে- ‘মা, তুমি কেন আলমারিতে তালা দিয়ে বাইরে যাও? মা বলছেন, যাতে বুয়ারা দামি জিনিস চুরি করতে না পারে। সন্তান তখন কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা তুমি তো আমাকে বুয়ার কাছে একা রেখে যাও। তাহলে আমি তোমার সবচেয়ে দামি জিনিস নই?’ সর্বশেষ বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন ও লেখা ছাপা হয়েছে। ডব্লিউইএফের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বে নারী-পুরুষের অসমতার হার আগের চেয়ে কমে দাঁড়িয়েছে ৬৮ শতাংশে। অর্থাৎ, সমতার দিকে এগোচ্ছে বিশ্ব। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নারী-পুরুষ সমতায় বাংলাদেশে সবার শীর্ষে। তবে সারা বিশ্বে পূর্ণ সমতা অর্জনে লাগবে ১৩২ বছর। বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে লাগবে আরো বেশি ১৯৭ বছর। মহামারির অভিঘাত এখনো শ্রমবাজারে অনুভূত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী তরুণদের বেকারত্বের হার চ্যালেঞ্জ হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। কর্মসংস্থান, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণে নেই- এমন মানুষের সংখ্যা এখনো অনেক বেশি, বিশেষ করে তরুণ নারীদের মধ্যে। তবে মহামারির পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার ২৯ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ৪২ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিশ্ব কর্মসংস্থান ও সামাজিক আভাস প্রবণতা ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব শ্রেণির মানুষের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার প্রাক-মহামারি পর্যায়ে একই হারে ফেরত যাবে না, বরং এ ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকবে।
তবে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তারপরও নারী-পুরুষের ব্যবধান থেকে যাচ্ছে, বিশেষ করে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থানের জন্য এসব বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকছে। আইএলও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পৌটিয়াইনেন বলেন, ‘শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি, বাল্যবিবাহ হ্রাস এবং শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণে নারী ও মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নারীদের জন্য নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এখন আমাদের যেটা করতে হবে তা হলো-নারী, তরুণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষতার উন্নয়ন করে তাদের শ্রমবাজারে সমানভাবে অংশ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা।’ মহামারি-পরবর্তী শ্রমবাজারে যারা পুনরায় প্রবেশ করছে, তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আগের সমপরিমাণ সময় কাজ করতে পারছেন না এবং তাদের অসুস্থতার মাত্রা বেড়ে গেছে। আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী বেকারত্বের হার বাড়বে এবং ক্রমবর্ধমান সামাজিক বৈষম্যের কারণে বাড়বে উদ্বেগ। যদিও ২০২৩ সালের বিশ্বে বেকারত্বের হার কিছুটা কমেছিল। ২০২২ সালে যা ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, তা ২০২৩ সালে ৫ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেকারত্বের হার এবং চাকরির জোগান ও চাহিদার ব্যবধানের হার উভয়ই (চাকরি খুঁজছেন এমন বেকার ব্যক্তির সংখ্যা) প্রাক্-মহামারি স্তরের নিচে নেমে গেছে। তবে ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব বাড়বে। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও স্থবির উৎপাদনশীলতা উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠবে। বিশ্ব কর্মসংস্থান ও সামাজিক আভাস প্রবণতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি সত্ত্বেও শ্রমবাজার আশ্চর্যজনকভাবে স্থিতিস্থাপক ছিল। তবে নতুন নতুন ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এসব ঝুঁকি ও সংকট মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রচেষ্টার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বাস্তবতা কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝা যাবে না বলে মনে করছে আইএলও। শ্রম বাজারে নাজুক পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। আইএলও’র অনুমান, শ্রম বাজারের আভাস ও বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব উভয়ই খারাপ দিকে যাচ্ছে। ২০২৪ সালে অতিরিক্ত ২০ লাখ মানুষ বাজারে কাজ খুঁজবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জি-২০ ভুক্ত বেশির ভাগ দেশেই মানুষের কর-পরবর্তী আয় কমেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের জীবনযাত্রার মান কমেছে, যে ক্ষতি দ্রুত পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে উচ্চ ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়ে গেছে। ২০২৩ সালে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে চাকরির জোগান-চাহিদার ব্যবধানের হার ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ; নিম্ন-আয়ের দেশে যা ২০ দশমিক ৫ শতাংশে উঠেছে। একইভাবে ২০২৩ সালে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশ থাকলেও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। সেই সঙ্গে কর্মণ্ডদারিদ্র্য অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা আছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ২০২০ সালের পর এই হার দ্রুত হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী শ্রমিকের সংখ্যা (ক্রয়ক্ষমতার সমতার সাপেক্ষে দিনে ২ দশমিক ১৫ ডলারের কম আয়) ২০২৩ সালে প্রায় ১০ লাখ বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা সমতার সাপেক্ষে যাদের দৈনিক আয় ৩ দশমিক ৬৫ ডলার, অর্থাৎ যাদের মধ্যম সারির দরিদ্র বলা হয়, এমন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৮৪ লাখ। আয়বৈষম্যও বেড়েছে। মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া সমষ্টিগত চাহিদা বৃদ্ধি ও টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য নেতিবাচক হতে পারে। অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার স্থির থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে; ২০২৪ সালে যা ছিল বৈশ্বিক কর্মশক্তির প্রায় ৫৮ শতাংশ।
আইএলও মহাপরিচালক গিলবার্ট এফ হংবো বলেন, ‘এই ভারসাম্যহীনতা কেবল মহামারি পুনরুদ্ধারের অংশ নয়, বরং কাঠামোগত। শ্রমজীবীদের যেসব চ্যালেঞ্জ এর মধ্য দিয়ে চিহ্নিত হয়, তা ব্যক্তি জীবন ও ব্যবসা উভয়ের জন্যই হুমকি। এগুলো আমাদের কার্যকরভাবে ও দ্রুত মোকাবিলা করতে হবে। ধারাবাহিক মূল্যস্ফীতির সঙ্গে জীবনযাত্রার মান হ্রাস ও দুর্বল উৎপাদনশীলতা বৈষম্যের বাস্তবতা তৈরি করে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জনের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে। বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়বিচার ছাড়া আমরা কখনোই টেকসই পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে পারব না।’