জিআই মর্যাদার অপেক্ষায় দেশের ১৪ পণ্য

প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিয়ান স্ট্যালিন

কোনো দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে; সেই সাথে, ভৌগোলিকভাবে ও ঐতিহ্যগতভাবে যে পণ্যগুলোকে ‘নিজস্ব’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, তাহলে সেটিকে ওই দেশের ‘ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হচ্ছে কোনো সামগ্রীর ব্যবহার করা বিশেষ নাম বা চিহ্ন। এই নাম বা চিহ্ন নির্দিষ্ট সামগ্রীর ভৌগোলিক অবস্থিতি বা উৎস (যেমন একটি দেশ, অঞ্চল বা শহর) অনুসারে নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ১৭ নভেম্বর ২০১৬ সালে জামদানি স্বীকৃতি পায়। ১৭ আগস্ট ২০১৭ পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশকে বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জনের কথা ঘোষণা করে। এর ফলে ইলিশ বাংলাদেশের দ্বিতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত হয়। কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং ওই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ, সেই পণ্য শুধু ওই এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও উৎপাদন করা সম্ভব নয়।

কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়। জিআই হলো ভৌগলিক নির্দেশক চিহ্ন যা কোনো পণ্যের একটি নির্দিষ্ট উৎপত্তিস্থলের কারণে এর খ্যাতি বা গুণাবলী নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত জিআইতে উৎপত্তিস্থলের নাম (শহর, অঞ্চল বা দেশ) অন্তর্ভুক্ত থাকে। জিআই (এও) এর পূর্ণরুপ হলো (Geographical indication) ভৌগোলিক নির্দেশক। WIPO (world intellectual property organi“ation) হলো জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দানকারী প্রতিষ্ঠান। কোনো নির্দিষ্ট স্থানের কোনো পণ্য খুব নামকরা হলে এবং সেই নামের ওপর বিশ্বাস করেই পণ্যটি কেনা ও ব্যবহার করার গুরুত্ব দিতেই এই জিআই সনদ দেয়া হয়। প্রতিটি পণ্যের সঙ্গে সে স্থানের নাম যুক্ত করা হয়। যেমন- ঢাকাই জামদানি একসময় শুধু ঢাকার কারিগররাই উৎপাদন করতে পারতেন। আর ঢাকার আবহাওয়াও এ জামদানি তৈরির জন্য উপযোগী ছিল। ফলে যুগের পর যুগ তারা এ জামদানি তৈরি করে এসেছে, যা পৃথিবীজুড়ে স্বীকৃত। এর আগে বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো জিআই পণ্য হিসেবে ২০১৬ সালে স্বীকৃতি পেয়েছিল জামদানি। এরপর ২০১৭ সালে ইলিশ, ২০১৯ সালে খিরসাপাতি আম, ২০২০ সালে ঢাকাই মসলিন এবং ২০২১ সালে রাজশাহী সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, কালিজিরা চাল, দিনাজপুরের কাটারীভোগ চাল এবং নেত্রকোনার সাদামাটি মোট ৫টি পণ্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এক দশকে বাংলাদেশের ২১টি পণ্য পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি। যার মধ্যে শুধু গত বছরেই মিলেছে ১০টির স্বীকৃতি। আর এই স্বীকৃতি আদায়ের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সংগঠন ইডিসি। ২০২০ সাল থেকে একসঙ্গে কাজ করছেন ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের (ইডিসি) সদস্যরা। এটি অনলাইনে ভিন্ন ভিন্ন পণ্য নিউ জামদানি শাড়ির প্রসারে কাজ করেন।

পণ্য জিআই করার আগে দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই স্বীকৃতি দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। আর যে জেলার পণ্য জিআই হবে, তার জেলা প্রশাসক বা সরকারি কোনো দপ্তরকে আবেদন করতে হয়। কিন্তু দেখা গেছে, পণ্যের তালিকা করেও দীর্ঘ সময় ধরে এসব জেলা বা সরকারি কর্তৃপক্ষ ওই পণ্যের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত জমা দেয়নি। পণ্য জিআই হতে গেলে পণ্যের অন্তত ৫০ বছরের ঐতিহ্য থাকতে হয়, যে এলাকার পণ্য তার স্বীকৃতি থাকতে হয়। ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজই শুধু নয়, প্রাচীন সাহিত্য-পুঁথি-ছড়ায় কোনো উল্লেখ থাকলেও প্রমাণ হিসেবে তা তুলে ধরা হয়। এসব খুঁজে বের করা গবেষণার বিষয়। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মোট ২১টি পণ্য জিওগ্রাফিক্যাল আডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। এখন নতুন করে আরো ১৪টি পণ্যের জন্য জিআই আবেদন জমা পড়েছে। এ ছাড়া আবেদনের প্রক্রিয়ার মাঝে আছে আরও দু’টি পণ্য। বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী,

যে ১৪টি পণ্যের জন্য আবেদন জমা পড়েছে, সেগুলো হলো- যশোরের খেজুর গুড়; নরসিংদীর লটকন; নরসিংদীর অমৃতসাগর কলা; জামালপুরের নকশীকাঁথা; মধুপুরের আনারস; সুন্দরবনের মধু; মৌলভীবাজারের আগর-আতর; রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম; মুক্তাগাছার মণ্ডা; রাজশাহীর মিষ্টিপান; শেরপুরের ছানার পায়েশ; ভোলার মহিষের কাঁচা দুধ; গোপালগঞ্জের রসগোল্লা; নওগাঁর নাগ ফজলি আম; এছাড়া আবেদনের প্রক্রিয়ার মাঝে আছে আরো দু’টি পণ্য। যথা- দিনাজপুরের লিচু ও টাঙ্গাইলের শাড়ি। যদিও কোনো পণ্যের জন্য আবেদন করার অর্থ এই নয় যে সেগুলো জিআই সনদ পাওয়ার মতো যোগ্য বা পাবেই। নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নির্ধারিত হয় যে কোন পণ্য এই তালিকায় উঠবে। যাচাই-বাছাইয়ের পর এগুলোর কোনোটি যদি জিআই সনদ পেয়ে যায়, তাহলে তখন সেগুলো বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ করে। জিআই আইন বিধিমালা পূরণ করে।

এখন পর্যন্ত মোট ২১টি পণ্য জিআই সনদ পেয়েছে। সেগুলো হলো- জামদানি শাড়ি; বাংলাদেশের ইলিশ; চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম; বিজয়পুরের সাদামাটি; দিনাজপুরের কাটারিভোগ; কালোজিরা; রংপুরের শতরঞ্জি; রাজশাহীর সিল্ক; ঢাকার মসলিন; বাগদা চিংড়ি; রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম; শীতলপাটি; বগুড়ার দই; শেরপুরের তুলসীমালা; চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম; চাপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম; বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল; নাটোরের কাঁচাগোল্লা; টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম; কুমিল্লার রসমালাই; কুষ্টিয়ার তিলের খাজা। যদিও ডিপিডিটি’র ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের জার্নালে ১৭টি পণ্যের কথা উল্লেখ আছে।

জিআই কেন গুরুত্বপূর্ণ : দিন যত যাচ্ছে, বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে তত বাড়ছে পণ্যের স্বত্বের গুরুত্ব। এ কারণেই জিআই নিয়ে এত তোড়জোড়। কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীর কোনো সংস্কৃতি যদি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেই পণ্যটি ওই অঞ্চলের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০১২ সালের দিকে জামদানি শাড়ি, আম ও ইলিশকে জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় ভারত। অথচ এসব পণ্য বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু পণ্য জিআই করার জন্য দেশে তখন কোনো আইন ছিল না। বেশ দ্রুততার সঙ্গে ২০১৩ সালে সেই আইন হলো। আর প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত হলো জামদানি। বাংলাদেশের পণ্য হিসেবেই নথিভুক্ত হলো এই শাড়ি।