ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

লবণ উৎপাদনের রেকর্ড লক্ষ্যমাত্রা

লবণ উৎপাদনের রেকর্ড লক্ষ্যমাত্রা

আমাদের অনেকেরই এই গল্প জানা, রাজা এবং তার তিন কন্যার সেই গল্প। লোককথার সেই গল্পে রাজার ছোট মেয়ে তাকে বলেছিল, সে রাজাকে নুনের (লবণ) মতো ভালোবাসে। রাজা তাকে ভুল বুঝে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন। পরে অবশ্য রাজা তার মেয়ের কথা ও লবণের গুরুত্ব- দুটোই বুঝতে পেরেছিলেন। লবণ আসলে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝতে হলে বিশেষ কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন হবে না। একদিন লবণ ছাড়া খাবার খেলেই তা খুব পরিষ্কার হয়ে যায়।

খাবার ছাড়াও বিভিন্ন শিল্পে এই লবণের ব্যবহার করা হয়। তবে সাগরের নোনাজল থেকে এই লবণ কীভাবে মানুষের ঘরে এলো, তার ইতিহাস অনেক পুরোনো। বিভিন্ন ইতিহাস প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, হাজার হাজার বছর আগে থেকে মানুষ খাদ্যে লবণের ব্যবহার করে আসছে। তবে সেই লবণ এখনকার মতো সমুদ্রের পরিশোধিত ছিল না। তখন লবণ সংগ্রহ করা হতো খনি থেকে। পোল্যান্ড, তুরস্ক, বলিভিয়াসহ আরও বেশ কিছু দেশে এখনো লবণের খনির দেখা মেলে। সাধারণ লবণ দেখতে সাদা হলেও খনি থেকে তোলা লবণ বিভিন্ন রঙের হতে পারে। সাদা লবণ মূলত সমুদ্রের পরিশোধিত লবণ। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৬০০০ সালের দিকে বর্তমান রোমানিয়া অঞ্চলে বসবাসকারী লোকেরা লবণ আহরণের জন্য সাগরের পানি সেদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করত। সেই প্রাচীন আমল থেকেই পৃথিবীতে লবণের ব্যবহার শুরু হয়েছে। আর ভারতীয় উপমহাদেশে লবণশিল্পের বিকাশের শুরু মোগল আমলে, যার শুরুটা সমুদ্রে ঘেরা চট্টগ্রাম থেকেই। আর সমুদ্রের পাড়ে এই চট্টগ্রামে শুরুর দিকে লবণের চাষ শুরু করেছিল ‘মুলঙ্গী’ সম্প্রদায়ের লোকেরা। ‘মুলঙ্গী’দের হাতে যাত্রা শুরু: মোগল আমলে চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপের উপকূলীয় এলাকায় ‘মুলঙ্গী’ সম্প্রদায়ের লোকেরা বসবাস করত। তারা সমুদ্রের পানি সেদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করত। তাদের লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্রকে বলা হতো ‘তোফল’। দেশে গত বছর লবণের রেকর্ড উৎপাদন হয়, যা ছিল ৬২ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। চলতি মৌসুমে আবারও রেকর্ড লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার পরিমাণ ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মার্চ ও এপ্রিল মাসে সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হয়। মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও বৃষ্টি না হলে, আর ৩০ মে পর্যন্ত যদি উৎপাদন সম্ভব হয় তাহলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে লবণ রপ্তানি করা যাবে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) লবণ উৎপাদনে বিষয়টি তদারকি করে। প্রতিষ্ঠানটি নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসা, চাষিদের লবণ চাষে উৎসাহিত করা, মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া, প্রতিকূল আবহাওয়ায় লবণ সংরক্ষণে সহায়তাও করে থাকে। বিসিক থেকে জানা গেছে, লবণ উৎপাদনের মৌসুম শুরু হয় ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। আর শেষ হয় এপ্রিল মাসের ১০-১৫ তারিখের মধ্যে। তবে সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হয় মার্চ ও এপ্রিল মাসে। গত মৌসুম শেষ হয়েছিল এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখে। গত বছর লবণ উৎপাদন হয়েছিল ২২ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন। এবার তা বাড়িয়ে ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এখন প্রতিদিন ছয় হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হচ্ছে। আর চলতি মৌসুমে প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টন লবণ চাষ হয়েছে। কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া কেটে গেলে ধীরে ধীরে লবণ উৎপাদন বাড়বে।

২০২৩ সালে ৬৬ হাজার ৪২৪ একর জমিতে লবণ চাষ হয়েছিল। ২০২২ সালে যা ছিল ৬৩ হাজার ২৯১ একর। তবে ২০২৪ সালের কত একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে তার হিসাব শেষ হয়নি। সার্ভে চলছে। তবে বিসিকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বছর এক হাজার একর জমি বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, লবণের দাম বেশি থাকলে জমি চাষ বেশি হয়। তারা এমনও দেখেছেন, কক্সবাজারে যেসব জমিতে আগে ধান চাষ হতো, সেখানে এখন লবণ চাষ হচ্ছে। কারণ ধান চাষের চেয়ে লবণে লাভজনক। ২০২২ সালে চাষি ছিল প্রায় ৩৭ হাজার ২৩১ জন, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ৪৬৭ জনে। এবার যেহেতু জমি বেড়েছে, তাই চাষিও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে তা ৪০ হাজার ৫০০ জনে পৌঁছাবে। গত বছর চাষি পর্যায়ে প্রতিমণ বা ৪০ কেজি লবণের দাম ছিল ৩৫০ টাকা। কিন্তু এবার তা ৪৩০ টাকা কেজি। অর্থাৎ চাষি পর্যায়ে প্রতিমণ লবণের দাম গত বছরের তুলনায় ৮০ টাকা বেড়েছে। তবে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত তা ছিল ৫৩৫ টাকা। এই হিসাবে চলতি মৌসুমের শুরুর চেয়ে এখন চাষি পর্যায়ে দাম কিছুটা কমেছে, কিন্তু গত বছরের চেয়ে সামান্য বেশি রয়েছে। ফলে চাষিদের আয় বাড়ায় লবণ চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। অন্যদিকে পরিশোধিত লবণ গত দুই বছর ধরে ৪২ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বিসিকের কর্মকর্তারা বলছেন, কম্পানি পর্যায়ে লবণের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। চাষি পর্যায়ে দাম ওঠানামা করলেও কম্পানির দাম ফিক্সট রাখতে হবে। তা ছাড়া হঠাৎ করে লবণের দাম বাড়ালে কম্পানির লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে। নির্ধারিত দামের বাইরে কোনো কম্পানি লবণ বিক্রি করতে পারে না। কক্সবাজার জেলার চৌফলদণ্ডী ইউনিয়নে বঙ্গবন্ধু লবণ গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। ৩০ একর জায়গা নির্ধারণ ও যাচাইয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেখানে স্বল্প জমিতে কীভাবে বেশি লবণ উৎপাদন করা যায়, প্রযুক্তি কীভাবে উন্নত করা যায়, সেসব যাবতীয় বিষয়ে কাজ করা হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত