নতুন বছরের শুরুতেই রাজধানীতে অনিয়মতান্ত্রিক বাড়িভাড়া বৃদ্ধির কবলে পড়েছেন ভাড়াটিয়ারা। ব্যক্তিগত আয় না বাড়লেও উচ্চ জীবনমানের সঙ্গে অতিরিক্ত বাড়িভাড়া নাগরিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। বাড়িভাড়া বৃদ্ধির কারণে মূল শহর থেকে অনেক পরিবার উপ-শহরে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দামসহ জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে এমনিতেই সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছেন। এর মধ্যে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় বাসাভাড়া বাড়ছে নতুন করে। বছরের শুরুতেই এলাকাভেদে বাসাভাড়া বেড়েছে ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। কোথাও কোথাও ফ্ল্যাটের আকারভেদে ভাড়া বেড়েছে ৫ হাজার টাকাও। যারা ভাড়া বাসায় থাকেন, তাদের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায় মাস শেষে বাসাভাড়ায়। সাধারণত মানুষের খরচের তুলনায় আয় বেশি বাড়লে তাতে খরচ বাড়লেও মানুষের তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু দেশে গত দেড় বছর মূল্যস্ফীতির চেয়ে মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের মে মাস থেকে প্রতি মাসে যত মূল্যস্ফীতি হয়েছে, এর চেয়ে কম হারে মজুরি বেড়েছে। গত নভেম্বরে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। তার বিপরীতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ মজুরি যত বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এদিকে বাসাভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিকরা নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, গৃহঋণের সুদ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বৃদ্ধিসহ নানা যুক্তি দেখান। বিবিএসের হিসাবে, সদ্যবিদায়ী ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হিসাব পাওয়া গেছে। এই ১১ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
তার মানে হলো ২০২২ সালে একজন মানুষের যাবতীয় খরচ যদি ১০০ টাকা হয়, তাহলে ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৯ টাকা ৪৮ পয়সায়। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৪৮ পয়সা। এখন কোনো পরিবারের যদি ২০২২ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৩০ হাজার টাকা বাজার খরচ হয়, তাহলে ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৮৪৪ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি মাসে খরচ বেড়েছে ২ হাজার ৮৪৪ টাকা। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপ গরিব মানুষকে বেশি ভোগাচ্ছে। এখন বাড়তি বাসাভাড়া সংসার খরচের চাপ আরেক দফা বাড়াবে।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে দেশে একটি আইন আছে। সেটি ১৯৯১ সালের। ভাড়াটেদের স্বার্থ রক্ষায় অনেক কথা উল্লেখ আছে এই আইনে। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ নেই। ১৯৯১ সালে করা এ আইন বাস্তবায়নে এখনো কোনো বিধি করেনি সরকার। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ কার্যকর করতে ২০১০ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) নামের একটি সংগঠন জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিল। রিট আবেদনটির পরিপ্রেক্ষিতে রুল ও চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১ জুলাই আদালত রায় দেন। রায়ে বলা হয়, বিদ্যমান আইনটি কার্যকর না হওয়ায় ভাড়াটেদের সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। আইনটি কার্যকরে রাষ্ট্রকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে, অন্যথায় সাধারণ মানুষ এ থেকে পরিত্রাণ পাবেন না। রায়ে সারা দেশে এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
বিবিএসের তথ্য অনুসারে দেশে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে বাড়িভাড়া গড়ে পাঁচ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে দেশে বাড়িভাড়া গড়ে পাঁচ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাড়িভাড়া সূচকে (এইচআরআই) বলা হয়েছে—২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বাড়িভাড়া আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় শূন্য দশমিক শূন্য তিন শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে।এই প্রবৃদ্ধি আগের প্রান্তিকের তুলনায় কম। তখন বাড়িভাড়ার গড় বৃদ্ধি ছিল ছয় দশমিক ৮১ শতাংশ।
পাকা, আধা-পাকা এবং কাঁচা ও ঝুপড়িঘর- এই তিন ধরনের বাড়ির ভাড়া নিয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরো বাড়িভাড়ার হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। এইচআরআইয়ের তথ্য অনুসারে, গত অক্টোবর-ডিসেম্বর কাঁচাঘর বিভাগে ভাড়া সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। সূচক বেড়ে হয়েছে ১১২ দশমিক ৪৭। এটি এর আগের বছরে একই সময়ের তুলনায় প্রায় সাড়ে ছয় শতাংশ বেশি।
একইভাবে, টিনেরঘর বিভাগের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সূচক বেড়েছে ১১০ দশমিক ৮১। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ছয় দশমিক চার শতাংশ বেশি। ভোক্তা মূল্য সূচকের খাবারবহির্ভূত বিভাগে বাড়িভাড়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বাড়িভাড়া নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। চলমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এটি বাড়তি চাপ তৈরি করছে।
গ্রামে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ
একসময় আর্থিক সংকট কাটাতে মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসতেন। সময়ের পরিক্রমায় পাল্টে যাচ্ছে সেই চিরচেনা দৃশ্যপট। সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ায় ২০২২ সালে শহর থেকে গ্রামে ফিরে আসা মানুষের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অনুসারে, ২০২২ সালে প্রতি ১ হাজার মানুষের মধ্যে ১০ দশমিক নয় জন গ্রামে ফিরেছেন। এটি এর আগের বছরের তুলনায় ৮৪ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। এর বিপরীতে, গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা ৪৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেড়ে ২৬ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবও তাদের ওপর পড়েছে’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘মানুষ আর্থিক সংকট কাটাতে নানান কৌশল নেন। অভিবাসন এর অন্যতম।’ সাধারণত অর্থনৈতিক কারণে একটি পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তি কাজের জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যান। বিয়ের মতো সামাজিক কারণেও মানুষকে নতুন জায়গায় চলে যেতে হয়। বিবিএসের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে শহর থেকে গ্রামে আসা মানুষের সংখ্যা ছিল প্রতি এক হাজারে যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৭ ও ৩ দশমিক ৯। করোনার বিস্তার ঠেকাতে সরকার দেশব্যাপী লকডাউন দেওয়ার পর ২০২০ সালে তা বেড়ে ৮ দশমিক ৪ জনে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা ২০১৯ সালে ১ হাজারে ১৫ জন থেকে পরের বছর ১২ দশমিক সাতজনে নেমে আসে। মহামারি পরিস্থিতির উন্নতির পর বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা ২০২১ সালে প্রতি হাজারে ৫ দশমিক ৯-এ নেমে আসে। প্রায় ১৮ দশমিক চারজন শহর থেকে গ্রামে ফিরেছেন। এটি আগের বছরের তুলনায় ৪৮ শতাংশ বেশি। মহামারির আগের বছরগুলোয় মানুষ কাজের খোঁজে বা ব্যবসা করতে গ্রাম থেকে শহরে আসতেন। গ্রামে ফেরার পর খরচ মেটাতে যাদের সঞ্চয় আছে তাদের তা ভাঙতে হচ্ছে। মহামারির পর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবার চালু হওয়ায় অনেকে আবার শহরে ফিরে এসেছেন। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের ওপরে আছে। এটি দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষদের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।