বর্তমানে আমরা এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে অবস্থান করছি, যাকে সহজেই ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’ বা ‘ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন’ বা ‘ফোর আইআর’ বা ‘ইন্ডাস্ট্রি ফোর পয়েন্ট জিরো’র শুরুর লগ্ন বলা যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে কৃষি খাতে, বিশেষত বাংলাদেশের কৃষিতে ফোর আইআরের প্রভাব, সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ এবং তা মোকাবিলায় আমাদের করণীয় কী? কৃষি খাতের আঙ্গিকে বলা যায়, এ প্রযুক্তি পরিবেশের ওপর ন্যূনতম প্রভাব ফেলে কম খরচে অধিক ফলন ও পুষ্টি নিশ্চিত করে। সে বিবেচনায় উন্নত বিশ্বের কৃষিব্যবস্থা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশে শতকরা ৮৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করেন। কৃষিই তাদের প্রধান উপজীবিকা। ফলে পরিবারের সবাই ক্ষুদ্রায়তন পৈতৃক জমি চাষ করে। আর বাকি ১৫ ভাগ লোক বাস করে শহরে। এ দেশের কৃষকরা সাধারণত সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে থাকে। বেশিরভাগ কৃষক এখনো ফসল উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে লাঙ্গল, মই এবং গরু ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। সাধারণ অর্থে কৃষি বলতে ভূমি কর্ষণ করে ফসল ফলানো বুঝায়। কিন্তু অর্থনীতিতে কৃষি কথাটি আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থনীতিতে পশু পালন থেকে শুরু করে শস্য উৎপাদন, বনায়ন, মৎস্য সম্পদ আহরণসহ সকল প্রকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ প্রক্রিয়াকে কৃষির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কৃষি দেশের অর্থনীতির একটি অপরিহার্য উপাদান। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি এবং গ্রাম এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধির জন্য কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ধান, পাট, তুলা, আখ, ফুল ও রেশমগুটির চাষসহ বাগান সম্প্রসারণ, মাছ চাষ, সবজি, পশুসম্পদ উন্নয়ন, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, বীজ উন্নয়ন ও বিতরণ ইত্যাদি বিষয়সমূহ এ দেশের কৃষি মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত।
গত অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে পাঁচ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এটি গত ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত পরিসংখ্যানে এ তথ্য জানা গেছে। গত বছরের মে মাসে প্রকাশিত অস্থায়ী প্রাক্কলনে দেখা গেছে যে, ২০২২-২৩ সালে অর্থনীতি বেড়েছে ছয় দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ২০২১-২২ সালে তা ছিল সাত দশমিক এক শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১১-১২ অর্থবছরের পর সবচেয়ে কম ছিল। তবে করোনা মহামারির সময় ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল তিন দশমিক ৪২ শতাংশ। সাময়িক সংখ্যার তুলনায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চূড়ান্ত প্রাক্কলনে কৃষি ও শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তবে পরিষেবা খাতে এটি কমেছে। অন্তর্র্বতীকালীন প্রাক্কলনের তুলনায় গত জুনে শেষ হওয়া গত অর্থবছরে পরিষেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ৪৭ বেসিস পয়েন্ট কমে পাঁচ দশমিক ৩৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এটি ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ছয় দশমিক ২৬ শতাংশ। কৃষি খাতে জিডিপি ৭৬ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে তিন দশমিক ৩৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিল্প খাতের জিডিপি ১৯ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে আট দশমিক ৩৭ শতাংশ হয়েছে। এক বছর আগে চূড়ান্ত প্রাক্কলনে এটি ছিল নয় দশমিক ৮৬ শতাংশ। মহামারির দীর্ঘ প্রভাব ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ে। রিজার্ভ ও টাকার দাম দ্রুত কমেছে এবং মূল্যস্ফীতি বেড়েছে রেকর্ড ‘বাণিজ্য ও পরিবহন খাতেও মন্দা দেখা দিয়েছে। বিবিএসের তথ্য বলছে- জিডিপিতে ১৫ দশমিক ২৬ শতাংশ অবদান রাখা পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার প্রবৃদ্ধি ২৭ বেসিস পয়েন্ট কমে ছয় দশমিক ৩৮ শতাংশ হয়েছে। এটি ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল আট দশমিক ৪৬ শতাংশ। একই সময়ে জিডিপির সাত দশমিক ২৯ শতাংশ অবদান রাখা পরিবহন ও সংরক্ষণ খাত চূড়ান্ত প্রাক্কলনে ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমে হয়েছে পাঁচ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আবাসন, আর্থিক ও বিমা কার্যক্রম, গৃহায়ন ও খাদ্য পরিষেবায় মন্দার কারণে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে। গত বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো জিডিপি নিয়ে ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিএস। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের ওপরও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ছয় দশমিক শূন্য সাত শতাংশ। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। এটি ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল দুই দশমিক শূন্য সাত শতাংশ। সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ৮৭ শতাংশ থেকে কমে তিন দশমিক ৯৬ শতাংশ হয়েছে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে নয় দশমিক ৬৭ শতাংশ। আগের বছর শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল সাত দশমিক ১৭ শতাংশ। গত বছরের চূড়ান্ত প্রাক্কলনে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী দেখা গেলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে তা কমতে দেখা গেছে।