বেসরকারি রপ্তানি ফ্যাক্টর শিল্পগুলো বলছে, সরকারি সহযোগিতা পেলে বিদেশি উৎসবে দেশি পণ্যের অংশগ্রহণ সহজ হবে, অর্ডার বাড়ানোর পাশাপাশি পণ্য রপ্তানি করেও আশানুরূপ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। ময়মনসিংহের আরেকটি প্রত্যন্ত গ্রাম ভালুকজান। একসময় দারিদ্র্য ছিল এখানকার মানুষের জীবনসঙ্গী। পুরুষরা প্রতিদিন কাজ করলেও নারীরা ঘরের কাজ শেষে অবসর সময় কাটাতেন। কিন্তু এখন বদলে গেছে প্রতিটি বাড়ির উঠানের চিত্র। প্রতিটি বাড়িতে হোগলা পাতার হস্তশিল্প তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তাদের হাতে তৈরি পণ্য ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্তত ৮২টি দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভালুকজান, কয়ারচালাসহ চারটি গ্রামের আড়াইশ’ পরিবারের হাজার হাজার উদ্যোক্তা ও কারিগর এ কাজে জড়িত। বছরে ১২০ ধরনের পণ্য উৎপাদিত হয়, যার বাজার মূল্য বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকা। রাস্তা সংস্কার হলে বেচাকেনা দ্বিগুণ হতো বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। তবে নিত্যদিনের পণ্যের বাজারমূল্য বেশি থাকায় মজুরি বাড়ানোর দাবিও কারিগরদের। নোয়াখালী থেকে আসে হোগলাপাতা, নওগাঁ থেকে জলপাতা। সঙ্গে যুক্ত হয় পাটের আঁশ। বানানো হয় মোটা শক্ত রশি। সেই রশিতে তৈরি হয় দৃষ্টিনন্দন সব কারুপণ্য। এসব পণ্যের মধ্যে আছে ঝুড়ি, মোড়া, ল্যাম্পশেড, পাপোশ।
নোনাজলের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ হোগলা। এটি মাটির ওপরে ৭৬-৯০ ইঞ্চি লম্বা হয়। প্রস্থ ১ ইঞ্চি। শেকড় মাটিতে থাকে ১০-১২ ইঞ্চি। গোড়ার দিকের শেকড় খানিকটা কচুগাছের মতো। নদীর দুই ধারে জন্মায় গাছ। প্রাকৃতিকভাবেই মানুষ হোগলাপাতা পেয়ে থাকে। জুলাই-আগস্টে এ পাতা সংগ্রহ করা হয়। সম্প্রতি সাভারের ভাটপাড়া এলাকায় গড়ে তোলা গণি ক্রিয়েশন কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, টিনের শেড দেওয়া লম্বা ঘরেই চলছে হোগলাপাতার দড়িতে কারুপণ্য তৈরির কর্মযজ্ঞ। দুই পাশে থরে থরে সাজানো বিক্রির জন্য প্রস্তু কারুপণ্য। দারুণ মিশুক আর তারুণ্যদীপ্ত মাফুজুল গণি গল্পের ঝুড়ি খুলে বললেন, আজকের এ অবস্থানে আসা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। ২০১৮ সালে তিন মাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে সাভারের ভাটপাড়া এলাকায় মাত্র তিনজন কর্মী নিয়ে শুরু করেন হোগলাপাতার কারুপণ্য তৈরির কাজ। মাফুজুল গণি জানান, বর্তমানে কাজ করেন দুই হাজারের বেশি কর্মী। হোগলাপাতা থেকে তৈরি দড়ি আসে দেশের বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে। মাত্র একটি রুমে শুরু হওয়া কারখানাটির ব্যাপ্তি এখন চারটি শেডে। এখানকার কারুশিল্পীদের হাতের কারুকার্যে তৈরি হচ্ছে বাসকেট, হ্যাংগিং, ঝুড়ি, টপ, টেবিল ম্যাট, ফ্লোর ম্যাট, নার্সারি পট, মাদুল, সোফা সেট, ফুলদানিসহ প্রায় ২০০ ধরনের পণ্যসামগ্রী। গল্পের একপর্যায়ে মাফুজুল গণির গলা ধরে আসে, চোখ ভিজে ওঠে। সফলতার আগে নিদারুণ কষ্টের কথা মনে পড়ে যায় বারবার। সে সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘এ কাজ শুরু করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অর্থাভাবে দিন কেটেছে। শুরুর দিকে মিরপুরের ঝুটপট্টি থেকে সুতা সংগ্রহ করতাম। খরচ কমানোর জন্য মাথায় করে সুতা বয়ে আনতাম। সংকোচে থাকতাম বন্ধু বা পরিচিতজনরা দেখে ফেলে কি না! এক আত্মীয় কারখানার জায়গা ভাড়া দেবেন বলে কথা দিয়েও পরে আর দেননি। স্থানীয় এক বৃদ্ধা এগিয়ে আসেন তখন। এমন বহু বিষয় পাড়ি দিয়ে আমি এখানে।’
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিডি ক্রিয়েশনের অপারেশন ম্যানেজার মোতালেব হোসেন বলেন, গত অর্থবছরের হোগলাপাতা, বাঁশ, বেতসহ বিভিন্ন হস্তশিল্প মিলিয়ে ২০০ কোটি টাকার পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে পেরেছে।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর ফেস্টিভালে দেশে তৈরি এই সমস্ত পণ্য প্রদর্শন সহজলভ্য করা গেলে পণ্যের বিক্রি পাশাপাশি আয় বৃদ্ধি পাবে। এতে তৈরি হয় ফুলের টব, কিচেন বাস্কেট, টিস্যু বক্স, বিড়ালের বাস্কেট, ক্যারেট, শপিং বাস্কেট, ফ্লোর মেটসহ কুটির শিল্পের নান্দনিক বাহারি সব পণ্য। উদ্যোক্তারা জানান, পণ্যে ব্যবহৃত হোগলা পাতার দড়ি বরিশাল, নোয়াখালী থেকে কেনা হয়। পরে নিজ নিজ এলাকায় দক্ষ কর্মীদের মাধ্যমে ফরমেট অনুযায়ী তৈরি পণ্য সাপ্লায়ারদের সরবরাহ করা হয়। বিডি ক্রিয়েশন দেশের ১৩টি জেলায় হস্তশিল্প ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই হস্তশিল্প প্রকল্পে দেশের প্রায় ৫ লাখ উদ্যোক্তা ও কারিগরের কর্মসংস্থান হয়েছে।
পণ্যের গুণগত মান আরও বাড়িয়ে রপ্তানি বৃদ্ধিসহ দেশীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে ‘রংজুট বিডি কোম্পানি’ নামের কারখানা। খানসামা উপজেলার আলোকঝাড়ী ইউনিয়নের বাসুলী কালাম চেয়ারম্যান পাড়ায় আত্রাই নদের তীরে অবস্থিত রংজুট বিডি কোম্পানি। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সুই-সুতো দিয়ে পাট ও হোগলাপাতার নিত্যনতুন পণ্য তৈরিতে ব্যস্ত নারীরা। অন্যদিকে আধুনিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে পণ্য তৈরির কাজও চলছে। প্রশিক্ষিত এই নারীদের মাধ্যমে পাট ও হোগলাপাতা দিয়ে তৈরি হোগলার বাস্কেট, ফ্লোর রাস্ক, ওয়াল ডেকর, ফ্লোর ম্যাট, পাপোশ, ডোর ম্যাট, দোলনাসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হ”েছ। উদ্যোক্তা প্রকৌশলী কাইদুজ্জামান আজাদ বলেন, ‘টেক্সটাইল বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি করতাম। তখনই নজরে আসে এই পণ্য তৈরির কাজ ও বিশ্ববাজারে এর চাহিদা। পরবর্তী সময়ে শহর থেকে গ্রামে ফিরে এসে ঢাকার বিভিন্ন কোম্পানি থেকে অর্ডার নিয়ে ২০১৬ সালে নিজ গ্রামে এই কারখানা শুরু করি। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে এই কাজের পরিধি ও কর্মসংস্থান।’ তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে প্রায় কোটি টাকা স্থায়ীভাবে বিনিয়োগ করেছেন। এখন প্রতি মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ হয়। তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এক্সপোর্ট কোম্পানির মাধ্যমে এই পণ্যগুলো বিদেশে রপ্তানি করা হয়। প্রতি মাসে ২৫-৩০ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানি করা হয়। এ ছাড়া ঢাকা, খুলনা ও রংপুরের বিভিন্ন শোরুমে প্রতিনিয়ত পণ্য সরবরাহ করা হয়। তিনি আরও বলেন, সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা পেলে এই কাজের পরিধি আরও বাড়ানো সম্ভব।