মাঠপর্যায়ে কমেছে আলু উৎপাদন
সরকারি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন কম হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৩৭ হাজার টন
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
চলতি অর্থবছরে ১ কোটি ১৬ লাখ টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। যদিও প্রতিকূল আবহাওয়া ও কৃষকদের সময়ের আগেই আলু উত্তোলন করে বিক্রি করে দেয়ার প্রবণতায় সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিএই’র হিসাবে চলতি অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ ৬৩ হাজার টনের কিছু বেশি। সে অনুযায়ী দেশে এবার সরকারি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬ লাখ ৩৭ হাজার টন কম আলু উৎপাদন হয়েছে।
যদিও দেশে এবার কৃষিপণ্যটির প্রকৃত উৎপাদন সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক কম হয়েছে বলে দাবি করছেন হিমাগার মালিকরা। তাদের ভাষ্য মতে, হিমাগারগুলোয় এবার আলু জমা হয়েছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কম।
কৃষি খাত-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এবারের আলু উৎপাদন মৌসুমের (রবি) প্রায় পুরোটাজুড়েই অস্বাভাবিক আচরণ করেছে আবহাওয়া। ভরা শীতে কখনো টানা বৃষ্টি আবার কখনো ঘন কুয়াশায় রোগবালাই ছড়িয়েছে আলুর খেতে। এছাড়া বছরজুড়ে দাম বেশি থাকায় পরিণত হওয়ার আগেই আলু তুলে বিক্রি করে দিয়েছেন অনেক কৃষক, যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক উৎপাদনে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে আলু উৎপাদন হয়েছে ৪ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে। মোট ১ কোটি ৯ লাখ ৬৩ হাজার টন উৎপাদনের সিংহভাগই উচ্চফলনশীল জাতের, যার পরিমাণ ১ কোটি ১ লাখ ৫৬ হাজার টন। আর স্থানীয় জাতের আলু উৎপাদন হয়েছে ৮ লাখ ৭ হাজার টন।
সরকারি এ হিসাবে আলুর প্রকৃত উৎপাদন চিত্র উঠে আসেনি বলে দাবি করেন হিমাগার ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য মতে, প্রকৃত উৎপাদনের সঙ্গে সরকারি তথ্যের ব্যবধান নিত্যপণ্যটির বাজার অস্থিতিশীল করে তোলায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘কোল্ড স্টোরেজগুলোয় গত বছর (২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষ) ২৩ লাখ টনের মতো আলু জমা হয়েছিল। এটা ধারণক্ষমতার ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ বাকি ৩০ শতাংশই খালি ছিল। অথচ আগে হিমাগারগুলোয় আলু রাখারই জায়গা পাওয়া যেত না। আর গত বছর আলু উৎপাদন কম হওয়ায় এবার আগাম জাতের আলু অপরিণত বয়সেই বিক্রি হয়ে যায়। এ কারণে সরকারি হিসাবে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে; আমাদের ধারণা তা এত হবে না। নইলে আলুর মৌসুমেই কৃষকরা তা কেজিপ্রতি ২৫ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি করত না। এখন কৃষক পর্যায়েই প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা দরে। উৎপাদনের তথ্য ভুল হওয়ার কারণেই আলুর বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে সংযুক্ত কৃষি কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান বলেন, ‘দেরিতে শীত আসা এবং কম সময়ে তীব্র ঠান্ডা অনুভূত হওয়ায় এবার আলুর টিউবারের সংখ্যা কম ও আকারে ছোট হয়েছে। আবাদের জমি বাড়লেও এবার ফলন কমার এটি অন্যতম কারণ। এছাড়া মানসম্পন্ন বীজের অভাব এবং মূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতায় কৃষকদের অপরিপক্ব আলু উত্তোলনেরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ফলনশীলতায়। এবার প্রতি হেক্টরে আলু উৎপাদন হয়েছে ২৮ দশমিক ৬০ টন। যেখানে গত বছর হয়েছিল ৩০ দশমিক ১০ টন।’
লক্ষ্য অর্জন হয়নি আলু উৎপাদনে আরেক বৃহৎ জেলা বগুড়ায়ও। শীত ও ঘন কুয়াশার সঙ্গে হঠাৎ বৃষ্টি ও রোগবালাইয়ে জেলায় এবার কৃষিপণ্যটির উৎপাদন কমেছে প্রায় সোয়া লাখ টন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, স্বাভাবিক অবস্থায় বিঘাপ্রতি ফলন হওয়ার কথা ১১০ থেকে ১২০ মণ। সেখানে বিঘাপ্রতি ফলন হয়েছে ১০০ মণের নিচে। এছাড়া আবাদ শুরু থেকে বাজারে বিক্রি পর্যন্ত আলু উৎপাদনে খরচও বেশি গুনতে হয়েছে বলে দাবি করছেন কৃষকরা।
শিবগঞ্জ, সদর উপজেলা ও মহাস্থানগড় এলাকার কৃষকরা বলেন, জানুয়ারিতে আলু উত্তোলনের সময় বগুড়ায় আকস্মিক বৃষ্টি হয়েছে। এ বৃষ্টিতে আলুর খেতে পচন ধরে। বিভিন্ন রোগবালাই দেখা দেয়। এছাড়া ছিল প্রচণ্ড শীত ও কুয়াশা। এসব কারণে জমিতে ফলন কম হয়েছে।
উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি নওগাঁ জেলায়ও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, চলতি মৌসুমে জেলায় ১৯ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও ২০ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ করেছেন স্থানীয় চাষিরা। জেলায় আবাদকৃত জমি থেকে ৩ লাখ ৯৭ হাজার ২১৫ টন আলুর ফলন পাওয়া যাবে- এমনটাই প্রত্যাশা ছিল কৃষি বিভাগের। তবে এ বছর আলু বাজারদর বেশি হওয়ায় আলু পরিপক্ব হওয়ার আগেই অনেক চাষি খেত থেকে আলু তুলে বাজারে বিক্রি করেছেন। এতে উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৫১০ টনে।
আলু উৎপাদনে অন্যতম শীর্ষ জেলা মুন্সীগঞ্জ। এখানেও এবার আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ৪ হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৩৬ হাজার ২৫০ টন। যদিও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৩ টন। এছাড়া জেলায় এবার আলুর উৎপাদনশীলতাও কমেছে।
দেশে এবার আলুর উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্ট প্যাথলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে ব্যাপক হারে কৃষকরা অপরিণত আলু তুলেছেন। কারণ বাজারে দাম বেশি ছিল। এটি সার্বিক উৎপাদন কমানোয় ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া আবহাওয়ার বিরূপ আচরণে আলুতে রোগবালাইও ছড়িয়েছে বেশি। এতে দামের ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হতে পারে। তবে আলুর সংকট তীব্র হওয়ার শঙ্কা কম। কারণ মানুষ খাওয়া কমিয়েছে। দাম বেশি হওয়ার কারণে আগে যিনি ১০ কেজি আলু কিনতেন, তিনি এখন ৫ কেজি কিনছেন। সব মিলিয়ে সংকট তীব্রতা না পেলেও বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার একটা শঙ্কা থেকে যাবে।’
দেশে বর্তমানে আলুর বার্ষিক চাহিদা ৭৫ থেকে ৮০ লাখ টন। এর মধ্যে আলুর সংগ্রহ-পরবর্তী ক্ষতি হয় প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। সে হিসাবে বছরে আলু উৎপাদনের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ লাখ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৬ টন। যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে শুরুতে তা ছিল ১ কোটি ১২ লাখ টন। এরপর বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় সরকারি হিসাবের চেয়ে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ আলু উৎপাদন কম হয়েছে। এ কারণে গত বছরের শেষদিকে বাজারে অস্থিতিশীলতা শুরু হয়। এখনো তার রেশ কাটেনি।