উন্নয়ন বাজেট
কমছে সরকারি বরাদ্দ রেকর্ড হচ্ছে বৈদেশিক ঋণে
প্রকাশ : ২২ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
গত পাঁচ বছরের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রবৃদ্ধি এবারই সবচেয়ে কম। প্রতি অর্থবছর এডিপিতে দেশীয় মুদ্রার জোগান বাড়লেও এবার তা কমছে। অন্যদিকে সংকটকালে আরও বাড়ছে বৈদেশিক ঋণের বোঝা।
আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরে এডিপির আকার দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের এডিপি থেকে এটি মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা বেশি। শতাংশের হিসাবে প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশেরও কম। অথচ ২০১৯-২০ অর্থবছরে চূড়ান্ত এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ১ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকায়। বছরের ব্যবধানে এডিপি বেড়েছিল ৮ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ৬০১ কোটি টাকা, পরের অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৬০ কোটি টাকায়। সে হিসাবে বছরের ব্যবধানে বাড়ে ১৬ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, আগামী এডিপিতে স্থানীয় মুদ্রায় বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার এডিপিতি স্থানীয় উৎস থেকে দেওয়া হবে এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে মূল এডিপিতে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় আগামী এডিপিতে বরাদ্দ কমানো হচ্ছে ৪ হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় মুদ্রায় বরাদ্দ কমানোর ঘটনা এবারই প্রথম ঘটতে যাচ্ছে।
অন্যদিকে আগামী এডিপিতেই প্রথমবারের মতো বিদেশি সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্য ১ লাখ কোটি টাকা স্পর্শ করতে যাচ্ছে। চলতি এডিপিতে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে দেশীয় অর্থ কমলেও এডিপিতে ৬ হাজার কোটি টাকা বাড়ছে বৈদেশিক ঋণ।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিত কর্মকার বলেন, আমরা সব সময় দেখি সরকারি অর্থ এডিপিতে বেশি খরচ হয়। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ ৭০ শতাংশের বেশি খরচ হয় না। এজন্য এবার আমরা বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছি যাতে বেশি করে সঠিকভাবে খরচ করতে পারি। আমাদের প্রধান টার্গেট এডিপি বাস্তবায়ন বেশি করে দেশবাসীর কাছে উন্নয়নের সুফল বৃদ্ধি করা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানায়, সরকার বৈশ্বিক সংকটসহ নানা বিষয় বিবেচনা করে সময়োপযোগী এডিপি অনুমোদন করেছে, যাতে শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। সরকারের কৃচ্ছ্রসাধনের নীতির কারণেও এডিপি বরাদ্দ কমানো হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। তবে এবারও উন্নয়ন বাজেটে পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ দুই খাতে তুলনামূলক অর্থ বরাদ্দও থাকছে বেশি।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) প্রণয়নে গত ১৪ মার্চ নির্দেশনা দেয় পরিকল্পনা কমিশন। সেই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে সব বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছ থেকে এডিপির জন্য মোট দুই লাখ ৭৬ হাজার ৪০২ কোটি ৪৬ লাখ টাকার প্রাথমিক চাহিদা পাওয়া যায়। এরমধ্যে সরকারি অর্থায়ন এক লাখ ৮৫ হাজার ৩৯১ কোটি ১৯ লাখ টাকা ও প্রকল্প ঋণ-অনুদান ৯১ হাজার ১১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
পরে অর্থ বিভাগ থেকে পাঠানো নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপির আকার দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণপূর্বক কার্যক্রম বিভাগকে অবহিত করা হয়। এরমধ্যে সরকারি অর্থায়ন এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা বা ৬২ দশমিক ২৬ শতাংশ। উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে বৈদেশিক ঋণ-অনুদানের টার্গেট এক লাখ কোটি টাকা বা ৩৭ দশমিক ৭৪ শতংশ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এডিপিতে এক অর্থবছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়ছে ১৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
নতুন এডিপিতে ১৫টি খাতের আওতাভুক্ত মোট ৫৭টি মন্ত্রণালয়-বিভাগ/বাজেট এনটিটির প্রকল্পসমূহের অনুকূলে মোট বরাদ্দের পরিমাণ দুই লাখ ৫৮ হাজার ৬৭১ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
এছাড়া ১০টি উন্নয়ন সহায়তা খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ৯ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা/করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহের অনুকূলে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ১৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা/করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নসহ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত এডিপির মোট আকার দাঁড়ায় দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা।
এদিকে, নতুন এডিপিতে বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাত সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭০ হাজার ৬৮৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ২৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৪০ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। শিক্ষা খাতে ৩১ হাজার ৫২৮ এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ২০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা।
এছাড়া নতুন এডিপিতে সাধারণ সরকারি সেবা খাতে দুই লাখ ১৩৩ কোটি, প্রতিরক্ষা খাতে ৭১০ কোটি, জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষা খাতে ৩ হাজার ৩০৮ কোটি এবং শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ৬ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে।
পাশাপাশি কৃষি খাতে ১৩ হাজার ২২০ কোটি, স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়ন খাতে ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি; পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ খাতে ১১ হাজার ৮৯ কোটি, গৃহায়ণ ও কমিউনিটি সুবিধাবলি খাতে ২৪ হাজার ৬৮২ কোটি; ধর্ম, সংস্কৃতি ও বিনোদন খাতে ৩ হাজার ৪৯১ কোটি; বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ৪ হাজার ৭৮৬ কোটি এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৩ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নতুন এডিপিতে সাধারণ সরকারি সেবা খাতে ২ লাখ ১৩৩ কোটি, প্রতিরক্ষা খাতে ৭১০ কোটি, জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষা খাতে ৩ হাজার ৩০৮ কোটি এবং শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ৬ হাজার ৪৯২ কোটি, কৃষি খাতে ১৩ হাজার ২২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নতুন এডিপিতে স্থানীয় সরকার বিভাগে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ৩৮ হাজার ৮০৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এরপরই সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ৩২ হাজার ৪২ কোটি, বিদ্যুৎ খাতে ২৯ হাজার ১৭৬ কোটি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১৬ হাজার ১৩৫ কোটি, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ১৩ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এছাড়া রেলপথ বিভাগে ১৩ হাজার ৭২৫ কোটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ১২ হাজার ৮৮৬ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে ১১ হাজার ৩৮৭ কোটি, নৌপরিবহনে ১০ হাজার ৩৭৩ কোটি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৮ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নতুন এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা এক হাজার ১৩৩টি। এসব প্রকল্পের মধ্যে ১০টি মেগাপ্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতে।