মোটরসাইকেলের মতো যানবাহন ও ইলেকট্রনিক পণ্যের ক্ষেত্রে শতভাগ আমদানিনির্ভর ছিল বাংলাদেশ। দেশে এ ধরনের পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের পথ তৈরি করে ভোক্তা শ্রেণি হিসেবে মধ্যবিত্তের উত্থান। বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদন শুরুর মাধ্যমে ইলেকট্রনিকস ও মোটরসাইকেলের বাজার সম্প্রসারণে উৎসাহী হয়ে ওঠে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি। বিষয়টিকে আরো ত্বরান্বিত করে তোলে সরকারের নীতিসহায়তা ও প্রণোদনা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক দাবি অনুযায়ী, সরকারের নীতিসহায়তা ও অনুকূল শুল্ক কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের মাধ্যমেই বাংলাদেশের বাজারে মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, এসি ও মোবাইল ফোনের মতো ইলেকট্রনিক পণ্যের বেশির ভাগ সরবরাহ করা যাচ্ছে।
এসব পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে মান বিবেচনায় দেশে তৈরি ইলেকট্রনিক পণ্য ও বিদেশে তৈরি পণ্যের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানের দিক থেকে দেশে উৎপাদিত পণ্য বিদেশি পণ্যের চেয়ে এগিয়ে। এসব পণ্য উৎপাদনে সরকারের দেয়া নীতি সহায়তাগুলো আরো দীর্ঘমেয়াদি হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো উৎপাদন সক্ষমতাকে আরো টেকসই করে স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি বাজারও সম্প্রসারণ করতে পারবে।
বাংলাদেশ অটোমোবাইলস অ্যাসেম্বলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাফিজুর রহমান বলেন, অটোমোবাইল ও মোটরসাইকেল নিয়ে আলাদা দুটি শিল্প নীতিমালা প্রণয়ন হয়েছে। পরবর্তী সময়ে দুটি নীতিমালার আওতায় এনবিআর এসআরও দিয়েছে। সেখানে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে যে কী করলে একটি পণ্যকে বাংলাদেশে ম্যানুফ্যাকচারড বলে ধরে নেয়া হবে। এ নীতি সুবিধা ব্যবহার করে দেশে হোন্ডা, ইয়ামাহা, সুজুকি, বাজাজ- প্রায় সবাই ফ্যাক্টরি ফ্যাসিলিটি স্থাপন করেছে। এরা সবাই নির্ধারিত মানদ-ে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ধারণাটি বাস্তবায়ন করছে। এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে শুধু মোটরসাইকেল নয়, এর সঙ্গে ফ্রিজ, মোবাইল ফোন ও এসির মতো পণ্যের শিল্প-কারখানা স্থাপন হয়েছে।’ বাংলাদেশে ফ্রিজ ও এয়ারকন্ডিশনারকে (এসি) উৎপাদনে অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি ওয়ালটন। প্রতিষ্ঠানটির এএমডি এসএম শোয়েব হোসেন বলেন, ‘সরকারের নীতিগত সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়েই দেশি শিল্প উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় এখন ফ্রিজ ও এসির মতো পণ্যগুলো উৎপাদন সক্ষমতা বহুগুণ বেড়েছে। এসব পণ্যের মূল্য সংযোজন ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ শতাংশের বেশিও হয়। সরকারই বলে দিয়েছে যে স্থানীয় পর্যায়ে ম্যানুফ্যাকচারড বলতে গেলে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন হতে হবে। এটাই সবাই অনুসরণ করছে। এসব কারণে সরকার, দেশ ও জনগণ উপকৃত হচ্ছে। সরকারের এসব সুবিধা অব্যাহত রাখাসহ ক্রমে আরো বাড়াতে হবে। যাতে স্থানীয় শিল্প উৎপাদন সক্ষমতা আরো বাড়ে।’ বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এর মধ্যে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী এসির চাহিদা তুলনামূলক বেশি। স্ট্যাটিস্টার আরেক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের বাজার থেকে এসি কোম্পানিগুলো ২০২৪ সালে মোট ৯ কোটি ৩২ লাখ ৬০ হাজার ডলারের (সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী ১ হাজার ৯৪ কোটি ৪২ লাখ টাকার বেশি) সমান আয় তুলে নিতে পারে। ২০২৯ সাল পর্যন্ত পণ্যটির বার্ষিক বাজার প্রবৃদ্ধির গড় হার দাঁড়াতে পারে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশে। আর ওই সময় নাগাদ বছরে গড় ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে বাজারে এসির সরবরাহের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৭০০টিতে।
এসির বাজারে অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি ইলেকট্রো মার্ট গ্রুপ। দেশের চাহিদা পূরণ করে প্রতিষ্ঠানটি এখন বিদেশেও এসি রপ্তানির পরিকল্পনা করছে। কোম্পানির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. নুরুল আফছার বলেন, ‘বর্তমানে এ খাতের জন্য সরকারের নীতিমালা ইলেকট্রনিকস শিল্পে বিনিয়োগ ও কারখানা স্থাপনের জন্য যথেষ্ট অনুকূল বলে আমরা বিশ্বাস করি। প্রতি বছরই মেয়াদি কর অব্যাহতি বা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। যদি সেটি বছর মেয়াদি না করে দীর্ঘমেয়াদি করে দেয়া হয়, তাহলে এ খাতে আরো বিনিয়োগ বাড়বে। দেশে সেলফোনের বর্তমান বাজার প্রসঙ্গে মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশান অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মো. মেসবাহ উদ্দিন বলেন, বর্তমানে মোবাইল ফোনের আমদানি এবং কাঁচামালের বৈধ বাজারের কথা বললে ৯৫ শতাংশ আমাদের দেশেই উৎপাদন হয়। এর পাশাপাশি অবৈধ বাজারটাও অনেক বেশি জোরালো হয়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধ, পুরোনো ও প্রতারণার ফোন সংগ্রহ করা হয়। এ ফোনগুলোকে কেউ কেউ অবৈধভাবে বাংলাদেশে নিয়ে এসে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করতে পারছেন। এগুলোকে বাদ দিলে এখন আমাদের আমদানিনির্ভরতা অনেক কম।