দিনে দিনে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ছে। সরকারি হিসেবে জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১৫ লাখেরও বেশি। এই জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ কর্মক্ষম। কিন্তু যথেষ্ট কর্মসংস্থানের অভাবে কর্মক্ষম অনেক মানুষ বেকার আছেন। যদিও জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩৫ সালের পরে বাংলাদেশের এই কর্মক্ষম জনশক্তির হার কমতে থাকবে। বিপরীতে বাড়বে শিশু, বৃদ্ধদের মতো নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা।
অতীতে চীন-জাপানের মতো দেশগুলো তাদের বাড়তি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারলেও বাংলাদেশ সেটা কতটা কাজে লাগাতে পারছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু বাংলাদেশ কেন তার বিপুল শ্রমশক্তিকে কাজে লাগাতে পারছে না? এক্ষেত্রে তেমন উদ্যোগ ছিল না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস-এর হিসেবে, বাংলাদেশে সর্বশেষ জনশুমারি হয় ২০২২ সালে। এটির উপর ভিত্তি করে চলতি বছর জনসংখ্যার একটি প্রাক্কলিত হিসাব দেয়। সেই হিসাবে দেখা যায়, দেশটিতে এখন মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১৫ লাখ ৯০ হাজার। এরমধ্যে দেশটিতে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা ১১ কোটিরও বেশি। এই মানুষগুলোকেই মূলত: বলা হয় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী অর্থাৎ বয়সের দিক দিয়ে তারা কাজে নিযুক্ত হওয়ার উপযুক্ত। এই সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর ৬৫ শতাংশ।
অন্যদিকে যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে এবং ৬৫ বছরের উর্দ্ধে তাদেরকে বলা হয় নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী অর্থাৎ তারা জীবিকার জন্য অন্যের উপর নির্ভর করেন। এমন মানুষের সংখ্যা ৬ কোটির বেশি যা মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ।
সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, দেশটিতে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর চেয়ে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। এটি বলা হচ্ছে, ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্ট বা জনমিতিক লভ্যাংশের বোনাসকাল। বাংলাদেশ জনমিতিক লভ্যাংশের বোনাসকালের যুগে প্রবেশ করেছে ২০০৫ সালের পরে। তখন থেকে এটি ক্রমাগত উর্দ্ধমুখী, যা এখনো বজায় আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেন, শ্রমশক্তির দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে থাকলেও এটা বেশিদিন পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে জনসংখ্যা নিয়ে যে প্রক্ষেপণ সেটায় দেখা যাচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের যে সুবিধা সেটা সর্বোচ্চ ২০৩৫ বা ২০৩৭ সাল পর্যন্ত এটা উর্দ্ধমুখী থাকবে। অর্থাৎ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বাড়তে থাকেব। কিন্তু এরপর এটা কমতে থাকবে।
তিনি বলেন, ২০৪৭ সালের দিকে গিয়ে দেখা যাবে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর চেয়ে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাহলে যেটা হবে জনসংখ্যা কাঠামোয় এখন যে পরিবর্তন যেটা ২০৩৭ সাল পর্যন্ত আমাদের অনকূলে থাকবে। কোনও দেশে শ্রমশক্তি বাড়লে সেটা ওই দেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দিতে পারে। এজন্য দরকার হয় শ্রমশক্তি অর্থনীতিতে কাজে লাগানো। অর্থনীতিতে ব্যবহার করতে পারলেই সেটা ‘লভ্যাংশ’ হিসেবে বিবেচিত হবে।
অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেন, অথনীতির যে বিদ্যমান প্রবৃদ্ধি সেটা আরও বাড়ানোটাই হচ্ছে জনমিতিক লভ্যাংশ। এটা তখনই বাড়বে যখন কর্মক্ষম লোকগুলোকে কাজে লাগানো যাবে। এজন্য তাদেরকে শ্রম বাজারে আনতে হবে, চাকরি দিতে হবে, মানসম্মত জীবন-যাপনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
চ্যালেঞ্জ হিসেবে বাংলাদেশ যে বাড়তি শ্রমশক্তিকে ব্যবহার করতে পারছে না তার মূল কারণ দেশে যথেষ্ট কর্মসংস্থান নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস-এর হিসেবে দেশটিতে এখন বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। যদিও বাস্তবে সংখ্যাটা আরও বেশি বলেই মত অর্থনীতিবিদদের। এছাড়া বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিআইডিএস-এর তথ্যানুযায়ী দেশে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে যুব বেকারত্বই প্রায় ৮০ শতাংশ। ফলে দেশটিতে ব্যাপক কর্মসংস্থান দরকার। কিন্তু কাজের সুযোগ যথেষ্ট তৈরি হচ্ছে না। মোটাদাগে এর তিনটি কারণ তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত; কর্মমুখী শিক্ষায় ঘাটতি। গতানুগতিক শিক্ষা শেষে কাজ পাচ্ছে না তরুণরা। কারণ বাজারে যেসব কাজের চাহিদা, দেশের শিক্ষাপদ্ধতিতে তরুণদের মধ্যে সে দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত; বিদেশে নতুন শ্রমবাজার সেভাবে উন্মুক্ত হচ্ছে না। ফলে বেকারদের একটা বড় অংশের গন্তব্য অভিবাসন। কিন্তু সেটার সুযোগ সবার নে। আবার যারা শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের দক্ষতায়ও ঘাটতি থাকছে। ফলে তারা নিম্নমজুরির কাজ করছেন। এর ফলে রেমিটেন্সও কম আসছে। তৃতীয়ত; দেশে উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ উন্নত নয়। ফলে এখানে কোন চাকরিতে না গিয়ে যারা উদ্যোক্তা হতে চান, তারা যথেষ্ট পুঁজি পাচ্ছেন না এবং ব্যবসার পরিবেশেও ঘাটতি আছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারকে কর্মসংস্থানের জন্য নতুন নতুন সুযোগ তৈরি করতে হবে। এখানে তরুণদের যে দক্ষতা অর্জন হচ্ছে না, কাজ পাচ্ছে না এটার দায় শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকেই নিতে হয়। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিন্তু হচ্ছে। কিন্তু সেটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। কারণ এখানে বিনিয়োগ নেই। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ, বৈদেশিক বিনিয়োগ আশানুরূপ হচ্ছে না। যার কারণে এই অবস্থা। তরুণদের যে শিক্ষাগত যোগ্যতা সেটা চাকরিতে কাজে লাগছে না। সবাই গতানুগতিক অনার্স, মাস্টার্সের পড়াশোনা করছে। অথবা বিবিএ-এমবিএ করছে। বাজারে তো এতো চাহিদা নেই। এজন্য দক্ষতা-ভিত্তিক মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ও জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে বাড়তি শ্রমশক্তি কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির রূপান্তর ঘটানোর জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা প্রধানত দুটি খাতের কথা তুলে ধরছেন। একটি হচ্ছে, কর্মমুখী শিক্ষা। অপরটি হচ্ছে, স্বাস্থ্য। কিন্তু দুটোতেই বাংলাদেশের বাজেটে সরকারি বরাদ্দ নামমাত্র। শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা জিডিপির দুই শতাংশের কম, আর স্বাস্থ্যে সেটা এক শতাংশেরও নিচে। সুতরাং মানুষের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।