সরকার পতনের পর থেকেই ব্যাংকগুলোতে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ ও বিভিন্ন ধরনের অস্থিরতা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবির মুখে সরে গেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরসহ প্রায় পুরো নেতৃত্ব; দাবি উঠেছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তনেরও। এসব ব্যাংকে মালিকানা পরিবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে ভেতর ও বাইরে থেকে। এ কারণে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে।
জানা যায়, আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে ‘আর্থিক দুর্নীতি ও অর্থপাচারে জড়িতদের’ এবং দখলদারদের বিতাড়িত করতে কর্মচারীদের বিক্ষোভ চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিতাড়িতরা আবার ফিরে আসার জন্য বল প্রয়োগের পাশাপাশি সন্ত্রাসের পথেও হাঁটছেন। এমনকি অস্ত্রের মহড়াও চলছে ব্যাংকে ব্যাংকে।
গত রোববার একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামী ব্যাংকে প্রবেশ করতে গিয়ে বাধার মুখে এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে গুলিবিদ্ধ হন ছয়জন, যাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। পরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিরোধের মুখে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ আমলে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর হাত থেকে বেদখল হওয়া ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছে। গত তিন দিনে বেশ কিছু ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা পদত্যাগ করে ব্যাংক ছেড়ে গেছেন।
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা এসআইবিএল (সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি)-এর নিয়ন্ত্রণ নেন আগের উদ্যোক্তা পরিচালকরা। এছাড়া একই গ্রুপের অধীনে কয়েক মাস আগে নিয়ন্ত্রণে যাওয়া ন্যাশনাল ব্যাংকে আবার মালিকানা বদলের তোড়জোড় চলছে। বর্তমানে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা পলাতক আছেন। সব মিলিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ ব্যাংক ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ বন্ধ রেখেছে।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৭ সালে নিয়ন্ত্রণ হারানো বেসরকারি খাতের এসআইবিএলে গত বৃহস্পতিবার দলবল নিয়ে যান সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) ডা. রেজাউল হকসহ কয়েকজন পরিচালক। তারা দুই ডিএমডিকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। আর এদিন এমডি উপস্থিত ছিলেন না।
এছাড়া ২০১৭ সালে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের পরিবার ইউসিবির পর্ষদ থেকে পারটেক্স গ্রুপের সবাইকে সরিয়ে কর্তৃত্ব নেয়। সরকার পতনের পর বর্তমান পরিচালকদের আর ব্যাংকে ঢুকতে না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শেয়ারহোল্ডার ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
এছাড়া নামে-বেনামে ঋণ দিয়ে তা পাচারে সহায়তাকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা, অবৈধ নিয়োগ বাতিল, জোর করে চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে কিছু সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে সম্প্রতি বিক্ষোভ হয়েছে।
বেসরকারি খাতের আরেক ব্যাংক আইএফআইসির চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উপদেষ্টাসহ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোর প্রতিনিধিত্বকারী সবাইকে সরে দাঁড়াতে বলেছেন আইএফআইসি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত কর্মীরা। অস্থিরতা চলছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকেও।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ইসলামী ব্যাংকসহ এস আলম গ্রুপের মালিকানায় থাকা ব্যাংকগুলোয় যে ভঙ্গুর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার বিস্তৃতি কতটা, তা জানতে নিরীক্ষা করা দরকার। এর ভিত্তিতে ঠিক করতে হবে, এসব ব্যাংকের সংস্কার কীভাবে হবে এবং শেষ পর্যন্ত এগুলোর দায়দায়িত্ব কার ওপর দেয়া হবে।
আহসান এইচ মনসুর আরো বলেন, ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের হাতে থাকবে না অর্থ উপদেষ্টার উচিত এমন ঘোষণা দেয়া। এ ছাড়া কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া ব্যাংক, যেমন পদ্মা ব্যাংক- এমন ব্যাংকের ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ লাগবে। এসব ব্যাংক সরকার সীমিত সময়ের জন্য অধিগ্রহণ করতে পারে কিংবা অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করতে পারে।
এদিকে সিপিডি বলেছেন, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে বড় বড় অন্তত ২৪টি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এর মাধ্যমে লোপাট হয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। আর এই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।
সরকার পরিবর্তনের পর থেকে অস্থিরতা শুরু হয়েছে দেশের ব্যাংক খাতেও। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকেও চলছে চরম অস্থিরতা।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগ করা হচ্ছে, ব্যাংকগুলোর শীর্ষ কর্তারা নানা অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জড়িয়ে ব্যাংকের সর্বনাশ করেছেন। এজন্য তাদের পদত্যাগ ও শাস্তি দাবি করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এবার সেই দাবিতে ঘি ঢেলেছে দেশের শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাত থেকে ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে।
২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে বড় বড় অন্তত ২৪টি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এর মাধ্যমে লোপাট হয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এই অর্থ গত অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।
গতকাল সোমবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে ‘ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনতে করণীয়’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এ তথ্য তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংক খাতকে বাঁচাতে হলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে হবে এবং সময়মতো তথ্যের সততা ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শীর্ষ কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বের হতে হবে।
সিপিডি ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা আনতে আবারো একটি সুনির্দিষ্ট, সময় উপযোগী, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে। তারা বলছে, এই সংস্কার অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে হতে হবে। কারণ স্বার্থান্বেষী মহল এতে বাধা তৈরি করবে।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা সংকটজনক হলেও বেইলআউটের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে উল্লেখ করে সিপিডি বলেছে, ধসের দ্বারপ্রান্তে থাকা ব্যাংকগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। তাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ভালো ব্যাংকগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।