দেশের অবস্থা স্থিতিশীল হতে না হতেই লাগাতার ভারি বর্ষণ ও বন্যার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা সৃষ্টি হয়েছে। ভারি বর্ষণের কারণে চারদিকে পানি জমে স্থবির অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে কিছু কিছু জায়গা পানি সরতে শুরু করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করা কয়েক হাজার ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও প্রাইম মুভার আটকে আছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা থেকে মিরসরাই পর্যন্ত কমপক্ষে ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়েছে। বিকল হয়ে পড়েছে বহু গাড়ির ইঞ্জিন। যে গাড়ি এক দিনে আনলোড করে আবার ফেরার কথা, তা চার দিন পরও পৌঁছাতেই পারেনি গন্তব্যে। যানজটের মুখ থেকে পেছনে ফিরবে, নেই সেই সুযোগও। যানজটে আটকা পড়েছে বন্যাদুর্গতদের জন্য নিয়ে যাওয়া ত্রাণবাহী ট্রাক-লরি ও ছোটখাটো যানবাহনও। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, টানা বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কমেছে পণ্য খালাস কার্যক্রম। চট্টগ্রাম বন্দরে গত বৃহস্পতিবার থেকে পণ্য খালাসের হার স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় বন্যার কারণে সড়কে খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। ডুবে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। ফলে পণ্য নিয়ে সড়কে আটকা পড়ে আছে পণ্যবাহী যানবাহন। এদিকে চট্টগ্রাম থেকে রেলযোগাযোগ বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলপথেও পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বৃষ্টির কারণে বহির্নোঙরে পণ্য খালাস কম হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ডুবে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরাও পণ্য খালাস নেননি। জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হওয়া পণ্যের ৯০ শতাংশই ব্যবস্থাপনা করে চট্টগ্রামের বেসরকারি ডিপোগুলো। রপ্তানিকারকরা কারখানা থেকে কাভার্ডভ্যানে পণ্য এনে ডিপোর ছাউনিতে রাখেন। সেখানে কাস্টমসের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শেষে এসব পণ্য রপ্তানির উদ্দেশ্যে জাহাজে তুলে দেয়া হয়। এ ছাড়া ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য বন্দর থেকে ডিপোতে এনে খালাস করা হয়। আর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি হওয়া কনটেইনারের ৯৬ শতাংশই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবহার করে আনা-নেয়া করা হয়। বাকি ৩ শতাংশ রেলপথে ও ১ শতাংশের কম নৌপথে পরিবহন হয়। বেসরকারি কনটেইনার ডিপো সমিতির হিসাবে, চট্টগ্রাম বন্দ থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার টিইইউস কনটেইনার খালাস হয়। কিন্তু বৃষ্টি শুরুর পর ২১ আগস্ট চট্টগ্রামের ১৯টি ডিপোতে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার ঢুকেছে ৩ হাজার ৩৪৩ টিইইউস। তবে গত বুধবার তা কমে গেছে প্রায় ১ হাজারের মতো।
সেদিন রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার ঢুকেছে ২ হাজার ৩৩২ টিইইউস। গত শুক্রবার ঢুকেছে ২ হাজার ৫৬০ টিইইউস। আর শনিবার মাত্র ৯৮৫টি গাড়ি ঢুকেছে ডিপোগুলোতে। শনিবার পর্যন্ত ১১ হাজার ৯৩৫ টিইইউস কনটেইনার রপ্তানি বোঝাই করে জাহাজীকরণের অপেক্ষায় ছিল। ডিপোগুলোতে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে ৪৯ হাজার ১৮৯ টিইইউস আমদানি হওয়া পণ্যবাহী কনটেইনার। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, বন্যার পানির ওঠায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহন চলতে পারছে না। এ কারণে বন্দর থেকে কনটইেনার ডেলিভারি ব্যাহত হচ্ছে। তবে বন্দরের ভেতরে জেটিতে থাকা জাহাজে পণ্য ওঠানামা স্বাভাবিক। বৃষ্টির কারণে বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থানরত জাহাজগুলো থেকে খোলা পণ্য খালাসও ব্যাহত হচ্ছে। ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বৃষ্টি হলে বহির্নোঙরে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধ থাকে। টানা বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাস কম হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বন্দর থেকে পণ্য খালাসের হার ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় কম। তবে কনটেইনার খালাসে জটিলতা হয়নি। বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ডুবে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরাও পণ্য খালাস নেননি। বন্দর থেকে পণ্য খালাসে সমস্যা না হলেও চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে যাওয়ার কারণে পণ্য খালাসের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যহত হচ্ছে। চট্টগ্রাম পণ্য পরিবহন মালিক ফেডারেশনের সভাপতি আবু বক্কর ছিদ্দিক জানান, রাস্তার অবস্থা খারাপ থাকার কারণে চৌদ্দগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সমিতির দুটি গাড়ি উল্টে গেছে। আটকে আছে প্রায় এক হাজারের মতো গাড়ি। ফলে পণ্য পরিবহনে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি লাগছে। চট্টগ্রাম বন্দর ট্রাককাভার্ড ভ্যান মালিক ও কনট্রাক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জাহিদুল আলম জানান, বন্দর থেকে পণ্য নিতে সমস্যা হয়নি। ডেলিভারি নেয়ার পর শুকনা পণ্যগুলো পরিবহন করা হচ্ছে। তবে সড়ক ডুবে যাওয়া ও বৃষ্টির কারণে কাঁচামাল পরিবহন করা হচ্ছে না। এদিকে, রেল ও সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন আড়তে পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সবজির বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ সুযোগে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ এলাকায় পণ্যবাহী গাড়ি প্রবেশের তেমন কোনো চাপ নেই। আশপাশের চাক্তাই ও আছদগঞ্জসহ এই এলাকায় প্রতিদিন পণ্যবাহী গাড়ি প্রবেশ করে। সাম্প্রতিক সময়ে কারফিউ ও সড়কে সহিংসতার কারণে পণ্য সরবরাহ কমে যায়। এরপর টানা বর্ষণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ডুবে গেলে আরো মন্থর হয় পণ্য পরিবহন। বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা)’র একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ডিপো থেকে বন্দরে পণ্য আনা-নেয়া করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু সড়ক ডুবে যাওয়ায় ডিপোগুলোতে রপ্তানি পণ্য আসতে পারছে না। আগের তুলনায় রপ্তানিপণ্য তিন ভাগের এক ভাগে এসে ঠেকেছে।