১১ আগস্ট, ২০২৪-এ বাংলাদেশের রিজার্ভে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার কমে যাওয়ার ঘটনা নজর কাড়ে। আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য বন্ধের দিনেও এই ডলার পতন সবার মনে সন্দেহ জাগায়- দেশের রিজার্ভ কি আবার হ্যাকিংয়ের শিকার হলো? তবে, পরে জানা যায়, এ ঘটনা ছিল ইসলামী ব্যাংকের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার লেনদেনের জটিলতার ফল। ইসলামী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাওনা ডলার সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ায়, বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়ে রিজার্ভ সমন্বয় করে। সূত্র অনুযায়ী, সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের ইসলামী ব্যাংকের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও কুকীর্তি ঢাকতে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়।
ঘটনা ও কেলেঙ্কারির সূত্রপাত : ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে বাকিতে ডলার কেনার একটি নতুন পদ্ধতি শুরু করে। সেই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩৫ মিলিয়ন ডলার কিনে, সমান পরিমাণ টাকা ইসলামী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা দেয়। কিন্তু, ইসলামী ব্যাংক ধাপে ধাপে এই ডলার সরবরাহ করে, যা প্রায় এক বছর ধরে চলে।
এই ধারাবাহিকতায়, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত, বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক থেকে মোট ১.৬ বিলিয়ন ডলার কেনে। তবে, ব্যাংকটি সব ডলার সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়। এ কারণে, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভে এই টাকার যোগফল প্রদর্শন করে, যা ছিল আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান নিয়মের গুরুতর লঙ্ঘন।
রিজার্ভ সমন্বয়ের ঘটনা : অব্যাহত চাপে থাকা ব্যাংক কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেন ইসলামী ব্যাংকের পাওনা ডলারের হিসাব কেটে রিজার্ভ সমন্বয় করতে। ১১ আগস্ট, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৫, ৩১০ কোটি টাকা) কেটে নেয়া হলে, রিজার্ভ প্রায় আধা বিলিয়ন ডলার কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ১১ আগস্ট প্রতি ডলার ১১৮ টাকার বিনিময়ে বকেয়া ডলারের পরিমাণ নিষ্পত্তির জন্য এই টাকা কেটে নেয়া হয়।
বিশ্লেষকদের মতামত : অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, ‘বকেয়া ডলারের বিপরীতে টাকা ছাড় করা ডাবল এন্ট্রি সিস্টেমের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন এবং এটি একটি গুরুতর অপরাধ। এটি কেউ করে থাকলে তিনি রিজার্ভের হিসাবেও প্রতারণা করেছেন, যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এটি যদি ঘটে থাকে, তাহলে এটি জালিয়াতি নয়, বরং একেবারে ডাকাতির সমতুল্য। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।’
রিজার্ভ তথ্যের অস্বচ্ছতা : রিজার্ভের সঠিক তথ্য সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা তেমন কিছু জানাতে অক্ষম। ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রিজার্ভের তথ্য বর্তমানে অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগে সংরক্ষিত, তবে ৯ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত রিজার্ভের পরিসংখ্যান দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
৮ আগস্ট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৫.৮৯ বিলিয়ন ডলার, যা ১২ আগস্ট কমে ২৫.৪৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, ইসলামী ব্যাংকের হিসাব থেকে ৫, ৩১০ কোটি টাকা কেটে নেয়া হয়েছে, যা রিজার্ভ কমার কারণ।
রিজার্ভের সুদহার ও ইসলামী ব্যাংকের ভূমিকা : ইসলামী ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের বিলম্বের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ৫.৩০ শতাংশ সুদহারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের আংশিক (২.৬৫ শতাংশ) সুদ নেয়ার নির্দেশ দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সংকট এতটাই তীব্র ছিল যে, তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নগদ জমা স্থিতিও বজায় রাখতে পারেনি। সাবেক গভর্নর রউফ তালুকদার ও তার সহযোগীরা এই সংকট মোকাবিলায় নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করেন, যা রিজার্ভের হিসাবায়নকে বাস্তবে ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ হিসেবে পরিণত করে।