স্বর্ণ ব্যবসায় সিন্ডিকেট ও চোরাচালানের দাপট

বাংলাদেশে স্বর্ণের বাজার কতটা নিয়ন্ত্রিত?

প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিনিধি

সম্প্রতি দেশের স্বর্ণ ব্যবসায় একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার আগরওয়ালাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আগরওয়ালা বাংলাদেশ জুয়েলার্স এসোসিয়েশনের (বাজুস) সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ এনেছে সিআইডি। এই ঘটনা বাংলাদেশের স্বর্ণ ব্যবসা ও বাজার নিয়ন্ত্রণে ‘সিন্ডিকেটের’ ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানি না হওয়ায় এবং চোরাচালানকেন্দ্রিক এই খাতের ওপর পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকায় স্বর্ণের বাজার সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। বাংলাদেশে বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানি হয় না বলেই স্বর্ণের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের প্রভাব বেশি। ব্যবসায়ীরা স্বীকার করছেন, দেশে আসা স্বর্ণের একটি বড় অংশ চোরাচালানের মাধ্যমে আসে এবং বাজারে বিক্রি হয়। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে তারা স্বর্ণ আমদানির ত্রুটিপূর্ণ নীতিমালাকে দায়ী করেন। ২০১৮ সালে সরকার স্বর্ণ আমদানির নীতিমালা প্রণয়ন করলেও, তা কার্যকর হয়নি। ২০২১ সালে নীতিমালা সংশোধন করা হয় এবং ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে স্বর্ণ আমদানির লাইসেন্স দেয়া হয়। তবে, শুরুর দিকে কিছু প্রতিষ্ঠান স্বর্ণ আমদানি করলেও, পরবর্তীতে তা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত ট্যাক্স এবং আমদানি প্রক্রিয়ার জটিলতাকে দায়ী করেন। বুলিয়ান মার্কেট বা পোদ্দার মার্কেট, যা রাজধানী ঢাকার তাঁতীবাজারে অবস্থিত, বাংলাদেশের স্বর্ণের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। বাজুসের দাম নির্ধারণ কমিটি এই মার্কেটের মূল্য নির্দেশিকা অনুসরণ করে স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করে। এই বাজারের স্বর্ণের উৎস মূলত চোরাচালান বলে ব্যবসায়ীরাও স্বীকার করেন। এর ফলে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে কোনো সামঞ্জস্য ছাড়াই সিন্ডিকেট স্বর্ণের উচ্চমূল্য নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়। মাসুদুর রহমান, বাজুসের দাম নির্ধারণ কমিটির চেয়ারম্যান, দাবি করেন যে, তাঁতীবাজারের বুলিয়ান মার্কেট একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাদের মনোপলি বাজারের দাম নির্ধারণ করে, আর বাজুস বাধ্য হয় সেই মূল্য অনুসরণ করতে। সরকার বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানিকে উৎসাহিত করার জন্য ২০১৮ সালে আমদানির নিয়মাবলী সহজ করার উদ্যোগ নেয়। তবে, ব্যাগেজ রুলসের শিথিলতার কারণে চোরাচালানকৃত স্বর্ণ বৈধভাবে দেশে আনা সম্ভব হয়। এই নিয়মে একজন যাত্রী চার হাজার টাকার বিনিময়ে এক ভরি স্বর্ণ দেশে আনতে পারেন, যা স্বর্ণ আমদানির জন্য নির্ধারিত ট্যাক্সের তুলনায় অনেক কম। ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, একদিকে সরকার আমদানি নীতিমালা তৈরি করলেও, অন্যদিকে ব্যাগেজ রুলসের শিথিলতা চোরাচালানকে উৎসাহিত করছে। ফলে বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানির কোনো বাস্তব সুবিধা নেই। এনবিআর এবং সরকারের অন্যান্য সংস্থার অবহেলার কারণে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ১,২৬,৩২১ টাকা, যেখানে ভারতের কলকাতায় একই মানের স্বর্ণের দাম ছিল ১,১০,৬৫৩ টাকা। দুই দেশের স্বর্ণের দামে প্রায় ১৫,৬৬৮ টাকার পার্থক্য, যা বাংলাদেশে স্বর্ণের অতিরিক্ত দামের প্রমাণ দেয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর নজরদারি ও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শুধুমাত্র সীমান্তে কিংবা বিমানবন্দরে নজরদারি বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, বরং চোরাচালান সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এর পাশাপাশি বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানির প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে, যাতে ব্যবসায়ীরা বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি করতে উৎসাহিত হন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারকে বৈধ আমদানি প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে এবং যারা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এনবিআরকে এ বিষয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’ স্বর্ণ ব্যবসায় সিন্ডিকেটের প্রভাব ভাঙতে হলে স্বর্ণের বাজারে স্বচ্ছতা আনতে হবে। মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে হবে এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্বর্ণের দাম নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, সরকার যদি বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানির প্রক্রিয়া সহজ করে এবং করহার কমায়, তাহলে সিন্ডিকেটের ক্ষমতা অনেকাংশে কমে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানিকে উৎসাহিত করতে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ মূল্যে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ দিলে দেশের স্বর্ণ বাজারের ওপর সিন্ডিকেটের প্রভাব কমে আসবে।’ বাংলাদেশে স্বর্ণের বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাব এবং চোরাচালানের দাপট স্বর্ণের দামের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। স্বর্ণের বৈধ আমদানি প্রক্রিয়াকে সহজ করা এবং চোরাচালান সিন্ডিকেট ভেঙে স্বর্ণের বাজারকে মুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন।