সার্ক অঞ্চলে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা : বাংলাদেশ ব্যাংক
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য তুলনামূলকভাবে কম, যা সার্ক অঞ্চলের মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন চালু করা হলে উপকার পাওয়া যেতে পারে।
তবে এর জন্য প্রয়োজনীয় নীতিগত ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বৈশ্বিক বাজারে মার্কিন ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আমদানিনির্ভর দেশগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশকে আমদানি সীমিত করতে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যের ধারণা নতুন করে গুরুত্ব পেয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করার চুক্তি করেছে, যদিও এ উদ্যোগ এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর ভৌগোলিক নৈকট্য থাকলেও তাদের বাণিজ্যনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভিন্নতা রয়েছে। এসব ভিন্নতাই স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য করার পথে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে এবং বিনিময় হারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন উপকারী হতে পারে। তবে এই অঞ্চলের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন। সেক্ষেত্রে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য করার সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মোট জনসংখ্যা ১.৯ বিলিয়ন বা ১৯০ কোটি। এই দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি প্রায় ৪.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ভারতের অবদান সর্বাধিক, পরের অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা। তবে মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো প্রত্যেক দেশে ভিন্ন। যেমন, বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের কাছাকাছি, পাকিস্তানেও একই অবস্থা, তবে ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় পরিস্থিতি কিছুটা ভালো। এই বৈষম্যগুলো স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য করতে অসুবিধা সৃষ্টি করছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের কিছু সুবিধা থাকলেও মুদ্রার সীমিত রূপান্তরযোগ্যতা, বিনিময় হারের ওঠানামা এবং মুদ্রার বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমস্যা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রীলঙ্কা যদি বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে, তবে তারা বাংলাদেশি টাকা নেয়ার চেয়ে মার্কিন ডলারে মূল্য পরিশোধে আগ্রহী হবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে সীমিত গ্রহণযোগ্য মুদ্রা ব্যবহার করাও বাণিজ্যের পথে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছে:
১. মুদ্রার শক্তি বৃদ্ধি : দেশগুলোর উচিত মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় উদারতা আনা এবং রূপান্তরের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ কমানো। এর ফলে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হারও সহায়ক হবে।
২. শক্তিশালী আর্থিক অবকাঠামো : স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য করার জন্য একটি শক্তিশালী আর্থিক অবকাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। এই অবকাঠামোর মধ্যে অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি, ক্লিয়ারিং প্রক্রিয়া এবং লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এই প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য নিয়মকানুনের অভিন্নতা থাকাও গুরুত্বপূর্ণ।
৩. সঠিক মুদ্রা ও রাজস্বনীতি : স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের জন্য অংশীদার দেশগুলোর মধ্যে আস্থা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া মুদ্রা ও রাজস্বনীতি যথাযথভাবে প্রণয়ন করতে হবে, যাতে এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক লেনদেন নির্বিঘ্ন হয়।
৪. আইনি কাঠামো : মুদ্রা রূপান্তর ও আর্থিক নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে, যাতে ব্যবসায়ীরা নিরাপদে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য করতে পারেন।
বিভিন্ন দেশ ডলারের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে অনেক দেশ নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে রুপিতে এবং চীনের সঙ্গে ইউয়ানে বাণিজ্য করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্ববাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ এখনো মার্কিন ডলারে হয়, যদিও অন্যান্য মুদ্রার ব্যবহারও বাড়ছে। চীনা মুদ্রা ইউয়ানের ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে, এবং ভারতও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করছে। যুক্তরাষ্ট্র ডলারকে বিশ্ব রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় অন্যান্য দেশগুলো নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করতে আগ্রহী হচ্ছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সার্ক অঞ্চলে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য বাড়াতে হলে দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিক নীতিমালায় সামঞ্জস্য আনার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও জোর দিতে হবে। সঠিক নীতি ও কাঠামো গড়ে তোলা গেলে সার্ক অঞ্চলের বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে পারে।