বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে চলমান তারল্য সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। সংকটে থাকা পাঁচটি ব্যাংককে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে তারল্য সহায়তা পেতে গ্যারান্টি দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে পাঁচটি ব্যাংকের সঙ্গে গ্যারান্টি চুক্তি সই করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা এসব ব্যাংককে বাজার থেকে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ তৈরি করে দেবে। চুক্তি সই করা ব্যাংকগুলো এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করবে এবং তাদের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গ্যারান্টির জন্য আবেদন করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই আবেদনের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি বিবেচনা করে নির্ধারণ করবে, কোন ব্যাংক কত টাকা ধার নিতে পারবে।
সংকটের মূল কারণ : এতে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো বাজার থেকে সহায়তা নিতে সক্ষম হবে এবং তাদের তারল্য সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন কিছু ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতির খবর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আমানতকারীরা ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ উত্তোলন করতে শুরু করে। এর ফলে এই ব্যাংকগুলোতে তীব্র তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়, যা এখনো চলমান। এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে বেশ কয়েকটি ব্যাংক ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) এবং স্ট্যাচ্যুটরি লিকুইডিটি রেশিও (এসএলআর) বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গ্যারান্টি চেয়ে মোট ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি তারল্য সহায়তার আবেদন করেছে। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ৫ হাজার কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংক ৪ হাজার কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ২ হাজার কোটি টাকা এবং ইউনিয়ন ব্যাংক ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা তারল্য সহায়তার জন্য আবেদন করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নীতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন আর অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে সরাসরি তারল্য সহায়তা দেবে না। এর পরিবর্তে ব্যাংকগুলোকে আন্তঃব্যাংক মুদ্রা সরবরাহের মাধ্যমে সহায়তা নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে। নতুন এই নীতি অনুযায়ী, বাজারে সরাসরি অতিরিক্ত টাকা সরবরাহ না করে একটি ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তর করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর মাধ্যমে বাজারে টাকার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করার পরিকল্পনা করছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডিমান্ড প্রমিসরি (ডিপি) নোট রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদান করবে। এই গ্যারান্টি প্রক্রিয়ার ফলে, কোনো ব্যাংক যদি ধার শোধ করতে ব্যর্থ হয়, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই দায়ভার গ্রহণ করবে।
গ্যারান্টি প্রাপ্ত ব্যাংকগুলো : প্রাথমিকভাবে যেসব ব্যাংকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুক্তি সই করেছে, তারা হলো- ন্যাশনাল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। চুক্তির আওতায় এসব ব্যাংক বাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গ্যারান্টি সুবিধার জন্য আবেদন করতে পারবে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে সংকটগ্রস্ত ব্যাংকগুলো তাদের তারল্য ঘাটতি মোকাবিলার জন্য আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করতে পারবে। এটি সাময়িকভাবে হলেও তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য : বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণত সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করে থাকে।
তবে সরাসরি ঋণ প্রদান করলে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে, যা মুদ্রাস্ফীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে। তাই নতুন ব্যবস্থায়, বাজারের টাকাই এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে যাবে এবং এতে করে মুদ্রাস্ফীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে না। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট সামাল দেয়ার পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এই নীতি কার্যকর করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।