এডিবির পূর্বাভাস

২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ১০.১ শতাংশে পৌঁছাবে

প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

সরবরাহ বিঘ্ন এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতির মূল কারণ : এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তাদের সর্বশেষ পূর্বাভাসে জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ১০.১ শতাংশে পৌঁছাবে। চলমান সরবরাহ বিঘ্ন এবং মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়াকে এডিবি এই মূল্যস্ফীতির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এটি এপ্রিলে দেয়া পূর্বাভাসের তুলনায় ৩.১ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০.৪৯ শতাংশ, যা গত জুলাই মাসে ছিল ১১.৬৬ শতাংশ। তবে, এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন বছরে মূল্যস্ফীতির ওঠানামা লক্ষ্য করা গেছে। ২০২৩ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯২ শতাংশ, ২০২২ সালে ৯.৫২ শতাংশ এবং ২০২১ সালের আগস্টে এটি ছিল মাত্র ৫.৫৪ শতাংশ।

মুদ্রাস্ফীতির ক্রমবর্ধমান চাপ : এডিবি জানিয়েছে, সরবরাহ শৃঙ্খলের ব্যাঘাত এবং মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে দেশের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে উর্ধ্বমুখী করে তুলছে। উচ্চ আমদানি ব্যয় দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, বিশেষত খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রে। এডিবির মতে, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে পৌঁছাতে পারে। এ ছাড়া, এডিবি বলেছে, মূল্যস্ফীতির এই ক্রমবর্ধমান চাপ গত দুই বছরে ভোক্তাদের উপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। ২০২৩ সালের মধ্যভাগ থেকে শুরু হওয়া এই চাপ দেশের পরিবারের বাজেটে বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং জীবনযাত্রার ব্যয়কে বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশব্যাপী উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরো সংকট তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ব্যর্থ : ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার মূল্যস্ফীতি ৯.৭ শতাংশে উন্নীত হওয়ার পর চলতি অর্থবছরে তা ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। তবে এই প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে। এডিবির মতে, সরবরাহ শৃঙ্খলে চলমান সমস্যাগুলো এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা এ অবস্থার জন্য দায়ী। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরাসরি বাজার হস্তক্ষেপ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেয়া ঋণের অর্থায়ন এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা। তবুও, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের মন্দাভাবের কারণে সরকার মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি কমার আশাবাদ : এডিবির সতর্কতামূলক পূর্বাভাস সত্ত্বেও, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, ২০২৫ সালের মার্চ থেকে এপ্রিলের মধ্যে দেশের মুদ্রাস্ফীতি ৬-৭ শতাংশে নেমে আসবে। তিনি মনে করেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সরবরাহ শৃঙ্খল স্বাভাবিক হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। ড. মনসুর বলেন, ‘সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যার মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।’ তিনি আরো বলেন, খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করা, মুদ্রার মান স্থিতিশীল রাখা এবং আমদানি ব্যয় হ্রাস করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

ভোক্তাদের উপর চাপ অব্যাহত : এডিবির মতে, চলমান মুদ্রাস্ফীতি এবং পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি, আর্থিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার পাশাপাশি আমদানি ব্যয় হ্রাস ও বাজার তদারকির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখতে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ : ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতির পূর্বাভাস অনুযায়ী, সরকারকে কঠিন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য ও জ্বালানির উচ্চ আমদানি ব্যয় এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। তবে, সরকারের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশ মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।