ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকট

খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ শতাংশে

প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (ঘইঋও) এখন চরম সংকটের মধ্যে আছে। অনিয়ম, দুর্নীতি এবং ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে এ খাতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিষ্ঠান গভীর সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে ১৫ থেকে ১৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক, যেখানে বিতরণ করা ঋণের ৪৫ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি হয়ে পড়েছে। সামগ্রিকভাবে, এই খাতে মোট ঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশই বর্তমানে খেলাপি। বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি বছরের জুনভিত্তিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে যে খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে, তা পুরো চিত্র নয়। প্রকৃত খেলাপির হার আরো বেশি হতে পারে, যা এ খাতের জন্য মারাত্মক অশনিসংকেত। বিশেষজ্ঞদের মতে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কার্যত ধ্বংসের পথে রয়েছে, কেবল হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এখনো টিকে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (ঘইঋও) রয়েছে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণকৃত ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে, যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।

আগের বছরের তুলনায়, ২০২৩ সালের জুন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি এবং অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার অধীনে পরিচালিত বা তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। পিকে হালদারের প্রভাবাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন পিপলস লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (ইওঋঈ), এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এর খেলাপি ঋণ ৯৪ শতাংশের ওপরে। এ ছাড়া পিকে হালদারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন এফএএস ফাইন্যান্স ও আভিভা ফাইন্যান্সেও খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

পিপলস লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের হার ৯৯ শতাংশ, যা মোট ঋণের প্রায় ১ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। বিআইএফসির খেলাপি ঋণের হার ৯৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ, যা প্রায় ৭৪৩ কোটি টাকা, এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ বা ৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। এফএএস ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৮৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং আভিভা ফাইন্যান্সের ৭১ দশমিক ৭২ শতাংশ। আভিভার পর্ষদ এরই মধ্যে পুনর্গঠন করা হয়েছে। পিকে হালদারের প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরেও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, এবং ফার্স্ট ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ যথাক্রমে ৯৪ দশমিক ৪১, ৯২ দশমিক ৩৭, এবং ৮৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ ৬৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ, সিভিসি ফাইন্যান্সের ৫৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ, এবং মেরিডিয়ান ফাইন্যান্সের ৫৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। আইআইডিএফসি, হজ ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স এবং ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণের হার ৫০ শতাংশের ওপরে।

এ ছাড়া উত্তরা ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৫০ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং বে লিজিংয়ের ৫২ দশমিক ৮২ শতাংশ। এই উচ্চ খেলাপি ঋণের হার দেশের পুরো ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতকে বড় ধরনের চাপে ফেলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ নুরুল আমিনের মতে, ব্যাংক খাতে যেভাবে সংস্কার কার্যক্রম চলছে, একই ভাবে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতেও সংস্কার কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণের চাপে ডুবে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন এবং পুনরুদ্ধারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, খেলাপি ঋণের একটি বড় অংশ আদায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। জুন পর্যন্ত মোট ২১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা আদায় অযোগ্য ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা মোট খেলাপি ঋণের ২৮ দশমিক ২২ শতাংশ। এত বড় পরিমাণ ঋণ আদায় অযোগ্য হওয়া এ খাতের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২০ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালের জুনে বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৩২৮ কোটি টাকায়। ২০২২ সালের জুনে এই সংখ্যা ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়, এবং ২০২৩ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকায়। এ থেকে বোঝা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে এবং এর ফলে এই খাতটি আরো গভীর সংকটে পড়ছে। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা মনে করেন, সামগ্রিক অর্থনীতির সংকট এবং আর্থিক খাতের অনিয়মের কারণে এই সংকট আরো বাড়ছে। বিশেষ করে ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা কমে যাওয়ায় খেলাপি ঋণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কিছু ভালো পরিচালনা ব্যবস্থার অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, সেগুলো পুনরায় স্থিতিশীলতার পথে ফিরে আসতে পারে। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সামান্য হলেও খাতটির জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত। এ সময়কালে আমানত বেড়ে ৪৫ হাজার ১১৬ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ৮১২ কোটি টাকা বেশি। তবে একই সময়ের মধ্যে প্রায় ৪৮ হাজার আমানতকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের আমানত তুলে নিয়েছেন, যা খাতটির প্রতি আমানতকারীদের আস্থাহীনতার চিত্র প্রকাশ করে।