ঢাকা ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আদানি বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে সরকারের চলমান পর্যালোচনা

আদানি বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে সরকারের চলমান পর্যালোচনা

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, বিশেষত ভারতের আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি নিয়ে। বিদ্যুতের উচ্চমূল্য, সরবরাহের নির্ভরতা এবং আইনি জটিলতার ঝুঁকি বিবেচনায় সরকার চুক্তিটি বহাল রাখার সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে বলে সূত্রমতে জানা গেছে।

২০১৭ সালে ভারতের আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ২৫ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি করে, যার আওতায় ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয় এবং বাংলাদেশের চাহিদার প্রায় এক দশমাংশ এই বিদ্যুৎ দিয়ে পূরণ হচ্ছে। তবে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার দামের বিষয়ে বিরোধিতা বাড়তে শুরু করলে সরকারের জন্য এটি একটি অস্বস্তিকর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

উচ্চমূল্য নিয়ে বিতর্ক : আদানি থেকে বিদ্যুৎ কেনার মূল্য বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় জনমনে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সরকারি অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, আদানির কাছ থেকে বাংলাদেশ প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য প্রায় ১২ টাকা প্রদান করছে, যা ভারতের অন্যান্য বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের তুলনায় ২৭ শতাংশ এবং রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি। এত উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষত যখন দেশের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দেশের কেন্দ্রগুলো অচল রেখে বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে।

এই বিষয়টি সরকারের জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠলেও আদানি পাওয়ারের সঙ্গে করা চুক্তি হঠাৎ বাতিল করা কঠিন হতে পারে। চুক্তি বাতিল করলে আদানি গ্রুপ আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা সরকারকে আরো জটিলতায় ফেলতে পারে। ফলে আদানি গ্রুপের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসে বিদ্যুতের দাম কমানোর পথ খুঁজছে সরকার, যদিও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি।

চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন : সম্প্রতি ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে পূর্ববর্তী সরকারের চুক্তিগুলো পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে আদানি পাওয়ারের চুক্তিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যদিও সরকার চুক্তির আইনি দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে সরাসরি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে অনিচ্ছুক, তবে চুক্তির পুনর্বিবেচনা এবং বিদ্যুতের দাম কমানোর সম্ভাবনা বিবেচনা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চুক্তিটি পর্যালোচনা করা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, ‘আদানির কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল। সরকার এই চুক্তি পর্যালোচনা করছে, এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। আশা করছি তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।’ আর্থিক চাপ এবং বকেয়ার বোঝা : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ডলার সংকটের ফলে আদানি পাওয়ারের কাছে বিদ্যুতের বকেয়া অর্থের পরিমাণ এখন প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আদানির বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে বাংলাদেশকে বড় ধরনের চাপের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আদানি ছাড়াও ভারতের অন্যান্য বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের মিলিয়ে বাংলাদেশের মোট বকেয়ার পরিমাণ এখন এক বিলিয়ন ডলারের বেশি।

আদানি পাওয়ারের মুখপাত্র জানিয়েছেন, তারা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে এবং বকেয়া অর্থ পরিশোধের আশ্বাস পেয়েছে। তবে কেন আদানির সরবরাহ করা বিদ্যুতের দাম অন্যদের তুলনায় বেশি, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি।

ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ এবং সমাধানের পথ : বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের ওপর আদানি চুক্তির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্ভরতা এবং আর্থিক বোঝা এই খাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। যদিও সরকার চুক্তিটি বাতিল করতে চাইছে না, তবে আদানির সঙ্গে দর কষাকষির মাধ্যমে দাম কমানোর প্রচেষ্টা চালানো হতে পারে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা এবং দেশের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা বাংলাদেশের জন্য একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে উৎপাদন খরচ কমানো জরুরি।

আদানির সঙ্গে চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কার্যকর সমাধান বের করা সরকারের জন্য একটি বড় পরীক্ষা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত