ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ ডট শপের মাধ্যমে ৩৫৮ কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে ১২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রধান আসামি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন গুলশান থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা। এ ছাড়া তার বোন সোনিয়া মেহজাবিন, সোনিয়ার স্বামী মাসুকুর রহমান এবং খালু জায়েদুল ফিরোজও এই মামলায় জড়িত। ই-অরেঞ্জের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) নাজমুল আলম রাসেল ও তার ভাই মঞ্জুর আলম পারভেজসহ আরো কয়েকজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ই-অরেঞ্জ গ্রাহকদের কাছ থেকে ৯৫৭ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। অস্বাভাবিক কম দামে পণ্য দেয়ার প্রলোভনে প্রতিষ্ঠানটি ৩ লাখেরও বেশি গ্রাহকের কাছ থেকে এই অর্থ নেয়। পরে গ্রাহকদের অনেকেই তাদের পণ্য পাননি। তদন্তে বেরিয়ে আসে, এই টাকার একটি বড় অংশ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকের গুলশান শাখায় ই-অরেঞ্জের মাধ্যমে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা স্থানান্তরের তথ্য পাওয়া গেছে। পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার শপ লিমিটেড (এসএসএল) ই-অরেঞ্জের মানি লন্ডারিংয়ে সহায়তা করেছিল বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।
খেলাপি ঋণের ক্রমবর্ধমান হার আর্থিক খাতকে নাজুক করে তুলছে : বাংলাদেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুরবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায়। তবে আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারির সঙ্গে বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের অনিয়ম এবং দুর্নীতি পুরো খাতকে আরো গভীর সংকটে ফেলেছে। তার অধীন থাকা বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই এখন খেলাপি ঋণের হার সর্বাধিক। এর প্রভাবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা পুরো আর্থিক খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন শেষে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা, যা এ খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। এই ঋণ বৃদ্ধির পেছনে পি কে হালদারের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি একটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
পি কে হালদারের কেলেঙ্কারি : পি কে হালদারের মালিকানাধীন এবং ব্যবস্থাপনায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনিয়ম এবং জালিয়াতির ঘটনা বেশ আলোচিত। তার অধীনে থাকা বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফিন্যান্স এবং আভিভা ফিন্যান্সে প্রচুর অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার অত্যধিক, যা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, পি কে হালদার–সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ে খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ, যা ৯৯ শতাংশ বা ১ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের হার ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ বা ৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা, এফএএস ফিন্যান্সে ৮৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা ১ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা এবং আভিভা ফিন্যান্সে ৭১ দশমিক ৭২ শতাংশ বা ১ হাজার ৯০২ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি : দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২৩ সালের জুন মাসে খেলাপি ঋণ ৩৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ২০২২ সালের শেষ দিকে এই খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা, যা তখনকার মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। গত দেড় বছরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৪ হাজার ৯৮ কোটি টাকা, তবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। এ থেকে বোঝা যায়, ঋণের তুলনায় খেলাপি ঋণের হার প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।
তা ছাড়া পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফিন্যান্স, আভিভা ফিন্যান্সসহ বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার অত্যধিক। ফারইস্ট ফিন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৯৪ দশমিক ৪১ শতাংশ, জিএসপি ফিন্যান্সের ৯২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ফার্স্ট ফিন্যান্সের ৮৯ দশমিক ৪১ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৬৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ, এবং সিভিসি ফিন্যান্সের ৫৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এ ছাড়া, মেরিডিয়ান ফিন্যান্স, আইআইডিএফসি, হজ ফিন্যান্স ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।
তদারকির অভাব ও আস্থা সংকট : আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এই বিপর্যয়ের পেছনে একটি বড় কারণ হলো যথাযথ তদারকির অভাব। ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগ নেয়ার সময় থেকেই আর্থিক খাতের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। এ সময় প্রশান্ত কুমার হালদারের নানা অনিয়মের বিষয়গুলো সামনে আসে এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার দুর্নীতি এবং জালিয়াতির প্রভাব ধীরে ধীরে পুরো খাতে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে গ্রাহকদের মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থাহীনতা দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্য এ খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কঠোর তদারকি ও নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও সামগ্রিক পরিস্থিতি এখনো খুবই নাজুক।
ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট : বর্তমানে দেশে ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো প্রতিষ্ঠান হলো আইপিডিসি ফিন্যান্স। তবে সামগ্রিকভাবে খাতটির বর্তমান অবস্থায় আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং খেলাপি ঋণের হার কমাতে সরকারের আরো সক্রিয় পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং কঠোর তদারকি ছাড়া এই খাতে দীর্ঘমেয়াদি উন্নতি সম্ভব নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত তদারকি, নতুন নীতিমালা প্রণয়ন এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এই খাতের স্থিতিশীলতা ফেরাতে সহায়তা করতে পারে।