বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪.৫ শতাংশে নামতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এটাই দেশের জন্য গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ, যদি মহামারি প্রভাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরকে বাদ দেয়া হয়। এর আগে, চলতি বছরের এপ্রিলে আইএমএফ ৬.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল। তবে বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন পূর্বাভাসে তা কমিয়ে আনা হয়েছে। গত ২২ অক্টোবর আইএমএফ তাদের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ এর সর্বশেষ সংস্করণে এই তথ্য প্রকাশ করে।
মূল্যস্ফীতি ও বৈশ্বিক প্রভাব : আইএমএফ তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলেও, বাংলাদেশসহ কিছু দেশে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি রয়ে যাবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মুদ্রাস্ফীতি ৯.৭ শতাংশ থেকে বাড়তে পারে এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ১০.৭ শতাংশে পৌঁছতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতির চাপ এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ যেমন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব, বৈশ্বিক সরবরাহ সংকট, এবং উচ্চ আমদানি ব্যয় প্রবৃদ্ধিকে সীমিত করছে। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বিশ্বব্যাংক ও এডিবির পূর্বাভাস : আইএমএফের মতো অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকাশ করেছে। বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) আগেই তাদের পূর্বাভাসে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কথা বলেছিল। বিশ্বব্যাংক চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশে নামার পূর্বাভাস দিয়েছে। তাদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বন্যা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশ এই প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার মূল কারণ। এপ্রিলে তারা ৫.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করেছিল, যা এখন আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে সংস্থাটি। এদিকে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস আগের ৬.৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫.১ শতাংশে নামিয়েছে। এডিবি উল্লেখ করেছে, দেশের রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহে স্থবিরতা এই প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিতে পারে।
চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিক্রিয়া : বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স বৃদ্ধি না হলে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসলে দেশের প্রবৃদ্ধি চাহিদার তুলনায় অনেক কম হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যায়। আমদানি খরচ কমাতে এবং ডলার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে নীতিগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ এবং অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা কঠিন হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার পাশাপাশি রপ্তানি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। দেশীয় শিল্প ও উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব বলে তারা মনে করছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও করণীয় : বাংলাদেশের জন্য বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার ও বেসরকারি খাতের একযোগে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, যাতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বজায় থাকে। পাশাপাশি, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে অর্থনীতির গতি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া দরকার। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ উভয় সংস্থাই বাংলাদেশের জন্য গঠনমূলক প্রস্তাবনা দিয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উন্নত নীতি প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন। এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে দেশের উৎপাদন খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমতে পারে, তবে সঠিক পরিকল্পনা ও নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।