বাংলাদেশের পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য বেসরকারি খাতের লিগ্যাল ফার্ম নিয়োগের পরিকল্পনা করেছে সরকার। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই পদক্ষেপের মাধ্যমে পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধার এবং দেশের অর্থনীতির শুদ্ধতা নিশ্চিত করতে কাজ করছে বাংলাদেশ। অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, এ উদ্যোগটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুত আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অংশ হিসেবে নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি, দেশের আর্থিক খাতে দরকারি কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা পেতে উন্নয়ন সহযোগীদের ইতিবাচক প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
গত মঙ্গলবার, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সাইডলাইনে বৈঠক করেছে, যেখানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এমডি, বিশ্বব্যাংক এবং আইটিএফসি প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় দাতা সংস্থার সঙ্গেও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক খাতের শুদ্ধতার প্রচেষ্টাকে উন্নয়ন সহযোগীরা ইতিবাচকভাবে দেখছে। দেশের পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা এবং আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কারিগরি সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে উন্নয়ন সহযোগীরা একমত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এই প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতের আন্তর্জাতিক লিগ্যাল ফার্ম নিয়োগ দেয়া হবে, যা পাচার হওয়া অর্থফেরত আনার প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করবে।
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ব্যাংক খাতের সংস্কার। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, দেশের ব্যাংকগুলোর সম্পদ মূল্যায়নের কাজ নভেম্বর মাস থেকে শুরু হবে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা যাচাই-বাছাই করা হবে। এর মাধ্যমে কোন ব্যাংক কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত তা নিরূপণ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে ঢাকাসহ ওয়াশিংটনে প্রায় ১০ বার আলোচনা হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে একটি রোডম্যাপ চূড়ান্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর সম্পদ মূল্যায়ন করা হবে, যা ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা তুলে ধরতে সাহায্য করবে।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি, তবে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন। এ জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা চাইছে, যা পাচারকৃত অর্থফেরত আনার পাশাপাশি ব্যাংক খাত সংস্কার এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কারের কাজেও প্রয়োজন হবে। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুতি সন্তোষজনক এবং তারা বাংলাদেশের উন্নয়নে অংশীদার হতে আগ্রহী। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষত, যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নীতি সহায়তা পাওয়ার বিষয়েও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াও আইএমএফের বোর্ডের কাছে অতিরিক্ত তিন বিলিয়ন ডলার সহায়তার আবেদন করা হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে। তবে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে এই অর্থের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
আইএমএফের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার হবে প্রায় ৪.৫ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা জানান, জিডিপি প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি নিয়ে সরকার খুব বেশি উদ্বিগ্ন নয়। বরং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে কাজ করছে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, বর্তমান সরকারের অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থসামাজিক উন্নয়ন। এই উন্নয়নের সুফল যেন সাধারণ মানুষ পায়, সেজন্য সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষত, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সহায়তা চাওয়া হয়েছে। বাজেট সহায়তার পাশাপাশি প্রকল্প ঋণের ক্ষেত্রেও দাতারা ইতিবাচক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
পাচারকৃত অর্থফেরত আনার প্রক্রিয়া দীর্ঘ এবং জটিল হলেও, সরকার এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক লিগ্যাল ফার্ম এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এছাড়া, ব্যাংক খাতের সম্পদ মূল্যায়নের মাধ্যমে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা আরও জোরদার হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, প্রতিটি বৈঠকে উন্নয়ন সহযোগীরা জানতে চাচ্ছে, বাংলাদেশের কী কী চাহিদা রয়েছে। তারা বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় আরও বেশি অর্থায়ন করতে প্রস্তুত।
আগামী ২৬ অক্টোবর উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আরো বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের জন্য আরো সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি আশা করা হচ্ছে।