যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের সম্ভাবনা কম
বন্যা পুনর্বাসনে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের শ্রম অধিকার ও মান নিয়ে সন্তুষ্ট না হওয়ায় মার্কিন বাজারে শিগগিরই জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (জিএসপি) বা অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা পুনর্বহাল হচ্ছে না। পাশাপাশি, দেশের সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল পুনর্গঠনের জন্য বিশ্বব্যাংক প্রায় ২৫ কোটি ডলার, যা প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার অনুদান, প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সভার সময় ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়ে এ বিষয়ে তিনি কথা বলেন। এ বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মার্কিন জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি জানান, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার ও শ্রম মান বিষয়ে আরো অগ্রগতি প্রত্যাশা করছে। তাদের মতে, বাংলাদেশকে শ্রমক্ষেত্রে বিভিন্ন মান বজায় রাখতে হবে, এবং তারপর বিষয়টি নিয়ে আরো পর্যালোচনা করা হবে।
বাংলাদেশে জিএসপি সুবিধার স্থগিতকরণ ও পুনর্বহাল প্রশ্ন : ২০১৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বেশ কিছু পণ্য জিএসপি সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত। তবে তৈরি পোশাক পণ্য এ সুবিধার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কিন্তু ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড ও ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনা, যেখানে সহস্রাধিক শ্রমিক প্রাণ হারায়, শ্রমিক নিরাপত্তা ও অধিকার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে, আমেরিকান অর্গানাইজেশন অব লেবার-কংগ্রেস ফর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (এএফএল-সিআইও) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, বাংলাদেশ শ্রমিক নিরাপত্তা ও মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়। তবুও ২০১৫ সাল থেকে বিভিন্ন টিকফা বৈঠক ও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করেও বাংলাদেশ জিএসপি পুনর্বহাল করতে সক্ষম হয়নি। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিনের মতে, মার্কিন প্রশাসন এ বিষয়ে উন্মুক্তভাবে সহায়তা করতে প্রস্তুত, তবে নির্দিষ্ট কিছু মানদ- পূরণের ব্যাপারে তারা অনড়।
বন্যা পুনর্গঠন ও অর্থায়ন : এদিকে সাম্প্রতিক বন্যায় দেশের পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে ধানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে পুনর্গঠনে প্রয়োজনীয় তহবিল জোগাতে বিশ্বব্যাংক ২৫ কোটি ডলার অনুদান প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের হিসেব অনুযায়ী, বন্যার ফলে প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ছাড়াও আইএমএফ, ওপেকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অর্থ সহায়তা প্রদানের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছে। ড. সালেহউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে এবং তারা সংস্কার কর্মসূচির বাইরেও কিছু অতিরিক্ত অর্থায়নে সম্মত হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য আরো অর্থ সরবরাহের জন্য বিশ্বব্যাংক ও ওপেকের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে, এবং তারা এ বিষয়ে বিবেচনা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।
মূল্যস্ফীতি ও ডলার পরিস্থিতি : বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা উল্লেখ করেন যে, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি চালু করা হয়েছে, তবে দীর্ঘ সময় ধরে সুদের হার সীমাবদ্ধ রাখার ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বড় ব্যবসায়ীরা এই পরিস্থিতির সুযোগ পেলেও এসএমই খাত অর্থ সংকটে পড়েছে। তিনি আরো জানান, আগের সরকারের সময় অতিরিক্ত অর্থ ছাপানো এবং ডলারের অস্থিতিশীলতা মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ। ড. সালেহউদ্দিন বলেন, বর্তমানে ডলার পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল হয়েছে। গত সরকার অনেক বিদেশি ঋণ পরিশোধ করেনি, যার কারণে সম্প্রতি ২.৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে এবং এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহার করতে হয়নি। বর্তমানে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে রিজার্ভ আরো বাড়ার আশা রয়েছে।
বাজেট সংশোধন ও সরকারি ব্যয় কমানোর উদ্যোগ : বাজেট সংশোধনের প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, পরিচালন ব্যয় কমানোর তেমন সুযোগ নেই, তবে উন্নয়ন ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো সম্ভব। গত অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরে ৩ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে।
শেয়ারবাজারে সংস্কার উদ্যোগ : বাংলাদেশের শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে ড. সালেহউদ্দিন জানান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, তারা বাজারের অনিয়ম চিহ্নিত করবে এবং এরই মধ্যে বেশ কিছু সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ে অতীতে কিছু সমস্যা থাকলেও, সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে বাজার দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল হবে। কয়েকজন সাবেক চেয়ারম্যানের শেয়ারবাজার রোডশো সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার দায়ও রয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, কিছু ক্ষেত্রে রোডশো চালানো হলেও সেই তহবিলের স্বচ্ছতা ছিল না। মোটকথা, শ্রম মান উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলি সমাধান ও মার্কিন জিএসপি সুবিধা পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে সরকার ও অর্থ উপদেষ্টা বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের পথে রয়েছেন।