পুঁজিবাজারের ১৪ কোম্পানি লভ্যাংশ না দেয়ার ঘোষণা
প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
বিশ্বজুড়ে চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মন্দার প্রভাব পুঁজিবাজারে উল্লেখযোগ্যভাবে পড়েছে। বেশিরভাগ কোম্পানি উল্লেখযোগ্য লোকসানের মুখে পড়েছে, যা তাদের লভ্যাংশ প্রদানে সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। তাদের মধ্যে ১৪টি কোম্পানি এ বছর তাদের শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২৪ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদ। এ সিদ্ধান্তে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। গত সোমবার অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় এ সিদ্ধান্তের অনুমোদন দেয়া হয় এবং গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে বিষয়টি প্রকাশিত হয়।
অর্থনৈতিক মন্দা এবং কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা :
১৪টি কোম্পানি ও তাদের আর্থিক পরিস্থিতি-
১. বসুন্ধরা পেপার : গত অর্থবছরে শেয়ার প্রতি ১.১০ টাকা মুনাফা করেছে। নিট সম্পদ মূল্য ৭৭.০৬ টাকা। এজিএম: ২৪ ডিসেম্বর।
২. মেঘনা পেট : শেয়ার প্রতি ২৭ পয়সা লোকসান এবং নিট সম্পদ মূল্য ৭৩.১৮ টাকা। এজিএম: ২৩ ডিসেম্বর।
৩. জিবিবি পাওয়ার : শেয়ার প্রতি ৩৫ পয়সা লোকসান এবং নিট সম্পদ মূল্য ২০.২৭ টাকা। এজিএম: ২৩ ডিসেম্বর।
৪. পেনিনসুলা চিটাগাং : শেয়ার প্রতি ১.০৪ টাকা লোকসান এবং নিট সম্পদ মূল্য ২৭.৮৪ টাকা। এজিএম: ৩০ ডিসেম্বর।
৫. মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক : শেয়ার প্রতি ৩.২১ টাকা লোকসান, নিট সম্পদ মূল্য মাইনাস ৬.১০ টাকা। এজিএম: ১৯ ডিসেম্বর।
৬. হামিদ ফেব্রিকস : শেয়ার প্রতি ৪.০৬ টাকা লোকসান এবং নিট সম্পদ মূল্য ৩৩.৬৬ টাকা। এজিএম: ২৬ ডিসেম্বর।
৭. স্টাইলক্রাফট : শেয়ার প্রতি ৬.৩২ টাকা লোকসান এবং নিট সম্পদ মূল্য ৫.৭০ টাকা। এজিএম: ১৮ ডিসেম্বর।
৮. উসমানিয়া গ্লাস : শেয়ার প্রতি ৬.৯২ টাকা লোকসান, নিট সম্পদ মূল্য ৭০.০৬ টাকা। এজিএম: ১৯ ডিসেম্বর।
৯. মেঘনা সিমেন্ট : শেয়ার প্রতি ৭.১৬ টাকা লোকসান এবং নিট সম্পদ মূল্য ৩৭.৬৪ টাকা। এজিএম: ২৩ ডিসেম্বর।
১০. সাফকো স্পিনিং : শেয়ার প্রতি ১২.৯৭ টাকা লোকসান এবং নিট সম্পদ মূল্য ২.৯৯ টাকা। এজিএম: ১৮ ডিসেম্বর।
১১. ম্যাক এন্টারপ্রাইজ: শেয়ার প্রতি ১৭ পয়সা লোকসান, নিট সম্পদ মূল্য ১.৯৪ টাকা। এজিএম: ২২ ডিসেম্বর।
১২. ম্যাক পেপার : শেয়ার প্রতি ৪.৮২ টাকা লোকসান, নিট সম্পদ মূল্য মাইনাস ২৩.২১ টাকা। এজিএম: ২২ ডিসেম্বর।
১৩. কোয়েস্ট বিডিসি : শেয়ার প্রতি ১৫ পয়সা মুনাফা এবং নিট দায় ১০২.৮৩ টাকা। এজিএম: ২২ ডিসেম্বর।
১৪. রেনউইক যজ্ঞেশ্বর : শেয়ার প্রতি ১৯.১৩ টাকা লোকসান এবং নিট সম্পদ মূল্য ২৩.০৭ টাকা। এজিএম: ২২ ডিসেম্বর।
বিশ্লেষকদের মতে, বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা হ্রাস এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে এই কোম্পানিগুলোর রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ফলস্বরূপ, গত অর্থবছরে তারা শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারছে না।
বিভিন্ন কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন-
বসুন্ধরা পেপার : কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ১ টাকা ১০ পয়সা মুনাফা অর্জন করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। নিট সম্পদ মূল্য ছিল ৭৭ টাকা ৬ পয়সা, তবে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান করা থেকে বিরত রয়েছে। তাদের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আগামী ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে।
মেঘনা পেট : কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ২৭ পয়সা লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে এবং তার নিট সম্পদ মূল্য ৭৩ টাকা ১৮ পয়সা। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে এ বছর কোম্পানিটি লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। তাদের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আগামী ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে।
জিবিবি পাওয়ার : গত অর্থবছরে কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ৩৫ পয়সা লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে, যদিও এর আগের বছর শেয়ার প্রতি ১ টাকা ১০ পয়সা মুনাফা করেছিল। নিট সম্পদ মূল্য ছিল ২০ টাকা ২৭ পয়সা। এজিএম অনুষ্ঠিত হবে ২৩ ডিসেম্বর।
পেনিনসুলা চিটাগাং : গত অর্থবছরে কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ১ টাকা ৪ পয়সা লোকসানে রয়েছে, আগের বছরের তুলনায় যা বৃদ্ধি পেয়েছে। নিট সম্পদ মূল্য ২৭ টাকা ৮৪ পয়সা। ৩০ ডিসেম্বর এজিএম অনুষ্ঠিত হবে।
মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক : কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ৩ টাকা ২১ পয়সা লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে, এবং নিট সম্পদ মূল্য মাইনাস ৬ টাকা ১০ পয়সা। আর্থিক সংকটের কারণে কোম্পানিটি এ বছরও লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারেনি।
কোম্পানিগুলোর লোকসানের কারণ ও পরিস্থিতি:
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশীয় অর্থনীতির মন্দা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সংকট এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে পুঁজিবাজারের কোম্পানিগুলোকে আর্থিক চাপে পড়তে হচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মুনাফা কমে গেছে। অধিকাংশ কোম্পানি ব্যয় সংকোচন এবং উৎপাদন খরচ কমানোর চেষ্টা করছে, তবে চাহিদার অভাবে তাদের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
অনেক কোম্পানি গত বছর থেকেও মন্দার সম্মুখীন হয়েছে, এবং কিছু কোম্পানি মুনাফা থেকে লোকসানে চলে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, হামিদ ফেব্রিকস, স্টাইলক্রাফট এবং উসমানিয়া গ্লাসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে।
শেয়ারহোল্ডারদের প্রতিক্রিয়া :
শেয়ারহোল্ডাররা এই লভ্যাংশ বন্ধের সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছেন। লভ্যাংশের ওপর নির্ভরশীল অনেক বিনিয়োগকারী আছেন যারা নিয়মিত আয় হিসেবে এটি বিবেচনা করেন। তাদের জন্য এই পরিস্থিতি বেশ চাপের হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের আরও সতর্কভাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হবে এবং কোম্পানির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিনিয়োগ করতে হবে।
সরকারের পদক্ষেপ:
বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যাতে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। রপ্তানি ও বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে নীতিগত সংস্কার আনার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাজার স্থিতিশীল রাখতে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।