ঢাকা ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পোশাক রপ্তানি আয় কমেছে ২০২৩-২৪ অর্থবছর

বিশ্ববাজারে চাহিদা ও অভ্যন্তরীণ সংকট প্রভাব ফেলেছে

বিশ্ববাজারে চাহিদা ও অভ্যন্তরীণ সংকট প্রভাব ফেলেছে

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত, যা দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় আয় কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই খাতে রপ্তানি আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় ২ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার বা ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ কমে ৩৬ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে আয় ছিল ৩৮ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার, এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে আয় ছিল ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। এটা বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য উদ্বেগজনক পরিস্থিতি, কারণ দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮১ দশমিক ২৪ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। রপ্তানিকারকরা মনে করছেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, বিদেশে চাহিদা হ্রাস, এবং ব্যাংক ঋণপত্র খোলায় জটিলতা- সব মিলিয়ে আয় কমার এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

গ্যাস সংকট ও আন্তর্জাতিক চাহিদা হ্রাস : পোশাক খাতে আয় কমার প্রধান কারণ হিসেবে ব্যবসায়িক নেতারা অভ্যন্তরীণ গ্যাস সংকট এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা হ্রাসকে দায়ী করছেন। নিট পোশাক শিল্প-মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, ‘গ্যাস সরবরাহ সংকটের কারণে কারখানাগুলোর উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা যখন জানেন যে উৎপাদনে অসুবিধা হচ্ছে, তখন তারা বিকল্প সরবরাহকারীদের দিকে ঝোঁকে।’ বিশ্ব বাজারে চাহিদা কমে যাওয়াও এর অন্যতম কারণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ পোশাক কেনার ক্ষেত্রে ব্যয় কমাচ্ছে, যা বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ভিন্ন পরিসংখ্যান : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৪৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। তবে আগের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মোট রপ্তানি আয় ৪০ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। দুটি তথ্যের মধ্যে এই ব্যবধান তৈরি হওয়ায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়, যা বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-এর মধ্যে হিসাব নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করে। ইপিবির সঙ্গে তৈরি হওয়া এই বিভ্রান্তি নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জানানো হয়, এবার থেকে তারা নিজেরাই রপ্তানির হিসাব সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করবে। ইপিবি অতীতে হিসাবগুলোতে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে দেখাত, যা নিয়ে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছিলেন।

এপ্রিল-জুন প্রান্তিকের আয় কমেছে ৩৬ শতাংশ : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিকে পোশাক খাতের রপ্তানি আয় ৩৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারে। জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রান্তিকে আয় ছিল ১৩ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। গ্যাস সংকট এবং ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার প্রভাব এখানে স্পষ্ট। বাংলাদেশের বড় রপ্তানি বাজারগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে রয়েছে। এছাড়াও জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, কানাডা, এবং বেলজিয়াম থেকে মোট ৬৩৫ দশমিক ৯২ মিলিয়ন ডলারের আয় এসেছে, যা মোট রপ্তানির প্রায় ৭২ শতাংশ। কিন্তু সেসব দেশেও চাহিদা কমে যাওয়ায় এই খাতে আয় কমেছে।

কাঁচামাল আমদানির খরচে চাপ : চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৩৭৯ দশমিক ৬৮ কোটি ডলার। এ সময়ে নিট রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৫০৪ দশমিক দুই মিলিয়ন ডলার, যা জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ কম। নিটওয়্যার (জামাকাপড়) বিভাগ থেকে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি আয় এসেছে ৪৭৪ দশমিক ৭৯ কোটি ডলার, ওভেন পোশাক বিভাগ থেকে এসেছে ৪০৮ দশমিক ৯১ কোটি ডলার। রপ্তানি আয় ও কাঁচামালের খরচের ভারসাম্য বজায় রাখতে কাঁচামাল আমদানির মূল্যবৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ে খাত সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

ঋণপত্র খোলায় জটিলতা : ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো পোশাক রপ্তানিকারকদের ঋণপত্র (LC) খোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করেছে, যা রপ্তানি শৃঙ্খলে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। ব্যাংকগুলোর এই বিধি-নিষেধের ফলে অনেক ব্যবসায়ী সময়মতো কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারেননি, যা তাদের উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে।

প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা : বিগত অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিকারকরা কাস্টমস থেকে নানা ধরনের জটিলতার মুখোমুখি হয়েছেন, যার ফলে পণ্য জাহাজীকরণে বিলম্ব হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে অনেক কিছুই স্থবির ছিল।

ব্যবসায়ী নেতারা আশা করছেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে। বর্তমানে গ্যাস সংকট আরো প্রকট হচ্ছে এবং খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন যে, ভবিষ্যতে এই সংকট না কাটলে রপ্তানি আয়ের ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অর্থ উপদেষ্টাসহ সরকারের বিভিন্ন স্তরে আলোচনা চললেও, দ্রুত কোনো সমাধান না আসায় উদ্বেগ বাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা এবং রপ্তানি আয় পুনরুদ্ধারে পোশাক খাতে বৈচিত্র্য আনার কথা ভাবছেন ব্যবসায়ীরা। বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে ডিজিটাল প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং নতুন বাজার অনুসন্ধান করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারকরা সরকার ও বিনিয়োগকারীদের সহযোগিতা কামনা করছেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত