ট্রেজারি বিলের সুদ বৃদ্ধিতে বিনিয়োগের আগ্রহ

প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

ট্রেজারি বিলের সুদের হার বৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রভাব পড়েছে, যা ব্যাংকিং খাতের আমানত এবং সঞ্চয়পত্রের সুদহারকে ছাড়িয়ে গেছে। গত ২১ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৯১ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদের হার ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা আগের মাসের তুলনায় ০ দশমিক ১৬ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি। অন্যদিকে, ১৮২ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদ হার বেড়ে ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং ৩৬৪ দিনের বিলের সুদ ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এসব ট্রেজারি বিলের সুদের হার ছিল ৯ দশমিক ২৫ থেকে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ, অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে সুদ বেড়েছে ২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট। তদুপরি, ভালো মানের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন আমানতে ৮ শতাংশ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে, যা ট্রেজারি বিলের তুলনায় কম। সরকার সাধারণত ৯১, ১৮২, এবং ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিল ও ২ বছর থেকে ২০ বছরের মেয়াদি বন্ড ইস্যু করে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধার নেয়, যার মাধ্যমে বাজেটের ঘাটতি পূরণ করা হয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, গত ২২ অক্টোবর পলিসি রেট বা রেপো রেট বাড়ানো হতে পারে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিল। ফলে ট্রেজারি বিলের সুদের হার বাড়িয়ে সরকারের পক্ষে প্রয়োজনীয় অর্থ ধার করা হয়েছে।

কেন বাড়ছে ট্রেজারি বিলের সুদের হার : ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রধানত দুইটি কারণে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার বাড়ছে। প্রথমত, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি পলিসি রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করেছে। এই রেট বৃদ্ধির কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের খরচ বেড়ে গেছে, যা ট্রেজারি বিলের সুদের হারের ওপরও প্রভাব ফেলছে। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে ট্রেজারি বিল ও বন্ড একটি লাভজনক ও নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। বিশেষ করে অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ব্যাংকগুলো এখন সরকারি বন্ড ও ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করলে আমাদের টাকা সময় মতো ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে। সুদের হারও ভালো।’

২০২৩ সালে বীমা ও ব্যাংক খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি : ২০২৩ সালে বীমা কোম্পানি মেটলাইফ বাংলাদেশ তাদের মোট বিনিয়োগের ১৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় এক হাজার কোটি টাকা বেশি। এ ছাড়া, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের মুনাফা ৪১ শতাংশ বৃদ্ধির পেছনেও ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের অবদান রয়েছে।

সঞ্চয়পত্রে সুদ হার ও সীমাবদ্ধতা : সরকার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ সুদ দিচ্ছে, যা একটি আকর্ষণীয় হার হলেও সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত ও সীমাবদ্ধতা আরোপিত হয়েছে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করার সুযোগ নিচ্ছে, কারণ ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগে কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই। এটি যে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য নিরাপদ বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচিত।

ট্রেজারি বিল কী এবং কোথায় পাওয়া যায় : ট্রেজারি বিল হল একটি স্বল্পমেয়াদি ঋণপত্র, যা সরকার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জারি করে এবং সাধারণত এর মেয়াদ এক বছরের কম হয়ে থাকে। ব্যাংক, পুঁজিবাজার, ব্রোকারেজ হাউস ও বিনিয়োগ ব্যাংক থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ড কেনার সুযোগ রয়েছে। তবে সব ব্যাংক এই সেবা দেয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ডিলার ব্যাংকগুলোই এই সেবা দিয়ে থাকে, পাশাপাশি তাদের সহযোগী ব্যাংক থেকেও ট্রেজারি বিল কেনা যায়। পুঁজিবাজারের মাধ্যমে বন্ড কেনা হলেও সেক্ষেত্রে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স বা বিও অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। ব্যাংক থেকে বন্ড কিনতে হলে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। তবে, পুঁজিবাজারের মাধ্যমে ১০০ টাকার বন্ডও কেনা যায়, যা অনেকের জন্য সহজলভ্য করে তুলেছে।

ভবিষ্যৎ প্রভাব ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত : ট্রেজারি বিল ও বন্ডের ওপর বর্তমান সুদের হার বৃদ্ধির ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির মুনাফায় ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে ব্যাংকিং খাত থেকে ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ গ্রহণে আগ্রহ কমে যাওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ব্যাংকগুলো ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ কমিয়ে ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করাকে নিরাপদ মনে করছে, যা অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।’ অন্যদিকে, এক বেসরকারি ব্যাংকের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মন্তব্য করেন যে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি একাধিকবার পলিসি রেট বাড়িয়েছে। এটি আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা ব্যাংকগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করতে ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২১ অক্টোবর ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে সরকার ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। তবে উচ্চ সুদের কারণে সব বিল বিক্রি করতে পারেনি। ৯ হাজার কোটি টাকা নিলামের জন্য তোলা হলেও বেশিরভাগ বিল কিনতে ব্যাংকগুলো চড়া সুদ দাবি করায় সরকার তা মঞ্জুর করেনি।

নিরাপদ বিনিয়োগের সম্ভাবনা বাড়ছে : ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের উচ্চ সুদের হার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় এটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ব্যাংকারদের মতে, ট্রেজারি বিলের মতো নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ মাধ্যমগুলোর প্রতি জনগণ ও প্রতিষ্ঠানের আস্থা বাড়ছে। তাদের মতে, দেশের আর্থিক খাতের নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ট্রেজারি বিল ও বন্ড একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে।