যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক বাজারে একসময়ের শক্তিশালী অবস্থান হারাতে বসেছে বাংলাদেশ। মার্কিন বাজারে ভোক্তাদের চাহিদা কমে আসায় দেশটির পোশাক আমদানিতে সংকোচন ঘটেছে, আর সেই পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকটি প্রতিযোগী দেশকে এগিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যখন কমতির দিকে, তখন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও ভারতের মতো দেশগুলো আমেরিকার বাজারে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মোট ৫৪১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৬.২৯ শতাংশ কম। ২০২২ সালে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা যুক্তরাষ্ট্রে ৭২৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছিলেন, তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি এবং উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয়ে ভোক্তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দেয়, যা রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হার ২০২২ সালের জুনে ৯.১ শতাংশে পৌঁছে যায়, যা ছিল ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর ফলে সাধারণ ভোক্তারা পোশাক ও অন্যান্য অ-প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটায় আগ্রহ হারান। যদিও বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমানো হয়েছে, গত বছর সেখানে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৪.১ শতাংশ। এর প্রভাব ২০২৩ সালেও অব্যাহত থাকায় এই বছর মার্কিন আমদানিকারকরা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২২ শতাংশ কম পোশাক আমদানি করেছেন, যার ফলে শীর্ষ পাঁচটি রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে প্রায় ২১ থেকে ২৫ শতাংশ রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম এবং ভারত নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনাম এ বছর ১,১২১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা গত বছরের তুলনায় ১.২৭ শতাংশ বেশি। মার্কিন বাজারে ভিয়েতনামের অংশীদারিত্ব বর্তমানে প্রায় ১৯ শতাংশ, যা বাংলাদেশকে অনেকটাই পেছনে ফেলেছে।
অন্যদিকে, ভারত এই বছর কিছুটা ধীরগতিতে হলেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে ফিরে এসেছে। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে ৩৬৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যার প্রবৃদ্ধি হার দশমিক ৪৬ শতাংশ। গত বছর ভারতীয় পোশাক রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ২১ শতাংশ কমে গিয়েছিল, তবে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে পুনরায় উন্নতি শুরু হয়েছে। কম্বোডিয়া ও পাকিস্তানও মার্কিন বাজারে তাদের রপ্তানি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, কম্বোডিয়া ২৭৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭.১৫ শতাংশ বেশি। একই সময়ে, পাকিস্তানের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৪১ শতাংশ, যা তাদের ১৫৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানিতে সহায়ক হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীন এখনো শীর্ষস্থানে থাকলেও, তারা গত বছরের তুলনায় ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে ফিরতে পারেনি।
এই বছরের প্রথম নয় মাসে চীন যুক্তরাষ্ট্রে ১,২৫১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১.৯৫ শতাংশ কম। যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পোশাকের বাজার হিস্যা বর্তমানে ২১ শতাংশে রয়েছে, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি হলেও ক্রমান্বয়ে কমছে। বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বর্তমানে পোশাক রপ্তানির বাজার হিস্যা ৯ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এটি তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশের অবস্থান হলেও, প্রতিযোগীদের তুলনায় প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী হার বাংলাদেশের জন্য একটি উদ্বেগজনক বিষয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য নতুন মার্কেট ও পণ্য বৈচিত্র্য বাড়ানো ছাড়া এই অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এবং মার্কিন বাজারে পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা উচ্চমূল্য সংযোজন সম্পন্ন পণ্য ও বিভিন্ন ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পোশাক উৎপাদনের উপর গুরুত্ব দিতে পারে।
এ ছাড়া, সরকারের পক্ষ থেকে রপ্তানিকারকদের সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন বাজারে প্রবেশে সুষ্ঠু নীতিমালা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা পুনরুদ্ধারে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, পণ্যের মান নিশ্চিত করা এবং বৈচিত্র্যময় পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা আবারো মার্কিন বাজারে তাদের স্থান ধরে রাখতে সক্ষম হতে পারেন।