ঢাকা ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আশাবাদী অন্তর্বর্তী সরকার

আর্থিক সংকট ও পুনর্গঠনে স্বল্পমেয়াদি সংস্কারের উদ্যোগ

আর্থিক সংকট ও পুনর্গঠনে স্বল্পমেয়াদি সংস্কারের উদ্যোগ

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, এবং দুর্নীতির প্রেক্ষিতে স্বল্পমেয়াদি সংস্কার কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি অর্থনৈতিক খাতে ক্ষতির গভীরতা সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন, ‘বাইরে থেকে এত বড় ক্ষতির কল্পনা করা কঠিন।’ তবে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাত এবং শেয়ারবাজারে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরে আসায় তিনি আশাবাদী। দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থায়ী সংস্কারের দায়িত্ব রাজনৈতিক সরকারের ওপর থাকবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

গতকাল শনিবার, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক ডায়ালগে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. সালেহউদ্দিন অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘দেশের আর্থিক খাতে এমন ক্ষতি হয়েছে যা বাইরে থেকে কল্পনা করা কঠিন।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আপাতত স্বল্পমেয়াদি সংস্কারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি, তবে স্থায়ী সমাধানের জন্য ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে।’ এই আলোচনা সভায় আরো অংশগ্রহণ করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কমিশনার ফারজানা লালারুখ, এবং ব্র্যাক ব্যাংকের সিইও সেলিম আর এফ হোসেন। সভায় প্যানেল আলোচনা, পোস্টার প্রেজেন্টেশন এবং আর্থিক খাতের চ্যালেঞ্জসমূহ এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হয়। ড. সালেহউদ্দিন তার বক্তব্যে বলেন, ‘খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন আড়াই লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা আগে ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর পেছনে কে বা কারা রয়েছে, তা অনেকেই জানেন।’

অর্থনৈতিক কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানি বাড়ানোর প্রচেষ্টা নেওয়া হলেও তা সবার জন্য সমানভাবে বণ্টিত হয়নি, ফলে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।’ তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বিগ্ন, তবে সরবরাহ ব্যবস্থায় ঘাটতির কারণে বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। বগুড়া থেকে ঢাকার কারওয়ানবাজারে পণ্য আনতে ১৭ জায়গায় ঘুষ দিতে হয়, যা বাজারের দামে প্রভাব ফেলে।’

ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংক খাত এবং শেয়ারবাজারে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরেছে। তবে, শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অস্থিরতা রয়েছে।’ শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা আনতে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি আরও জোর দেন।

তিনি উল্লেখ করেন, ‘সংস্কার করতে গেলে কিছু ব্যথা সইতে হবে। কিছু ব্যাংক তাদের আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, যা ব্যাংক খাতের গভীর সমস্যা নির্দেশ করে।’

সালেহউদ্দিন জানান, সীমাবদ্ধতার পরেও বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কৃষক ও সাধারণ মানুষের অবদান এ সাফল্যের পেছনে উল্লেখযোগ্য। তারা সাড়ে ৭ কোটি মানুষ থেকে ১৭ কোটি মানুষের খাবার উৎপাদন করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি দাবি করে যে বর্তমান উন্নয়ন শুধু আমার সময়ের কারণে হয়েছে, তা ঠিক নয়। এই উন্নয়ন কৃষক ও সাধারণ মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল।’ অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন জানান, দেশে থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে অর্থপাচার রোধে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আগামী দিনের জন্য এমন পলিসি তৈরি করা হচ্ছে যা অর্থপাচার রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।’

ড. সালেহউদ্দিন অভিযোগ করেন যে, পূর্ববর্তী সরকারগুলোর সময়ে সঠিক তথ্যপ্রবাহের অভাব ছিল, যা নীতিমালা প্রণয়নে জটিলতা তৈরি করেছে। তিনি বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছি তথ্যপ্রবাহ সঠিক রাখতে। সঠিক তথ্য না এলে নীতিমালা ভুল হতে পারে।’

ড. সালেহউদ্দিন পূর্ববর্তী সরকারের সমালোচনা করে বলেন, ‘অনেক প্রকল্প ফিজিবিলিটি টেস্ট ছাড়াই অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পগুলোর আয়ের সম্ভাবনা, ব্যয়ের হিসাব এবং ঋণের সুদের হার নির্ধারণে পর্যাপ্ত গবেষণা করা হয়নি।’ তিনি আরও জানান, বর্তমান সরকার উ‘চ সুদে ঋণ গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য উন্নয়নের বয়ানের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘তথ্য-উপাত্তের রাজনীতিকরণ করা হয়েছে, যার ফলে জিডিপি বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়নি।’

তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘জিডিপি বাড়লেও ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি পায়নি এবং তা ৮-৯ শতাংশে আটকে আছে। এত উন্নয়নের পরেও এই অর্থ কোথায় গেল তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা উচিত।’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা কি মধ্যম আয়ের ট্র্যাপে পড়তে যাচ্ছি? আমার মতে, আমরা এরই মধ্যে সেই ট্র্যাপে রয়েছি।’ তিনি বিনিময় হার, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য আর্থিক স্থিতিশীলতা আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

ড. সালেহউদ্দিন তার বক্তব্যের শেষে উল্লেখ করেন, ‘আর্থিক খাতের সংস্কারের কাজ সময়সাপেক্ষ হলেও আমরা সঠিক পথে এগোচ্ছি। দেশের উন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যাতে সুশাসন ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে উন্নয়ন সম্ভব হয়।’ তিনি আরও বলেন, দেশের আর্থিক খাতের পূর্ণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সমন্বিত এবং সুষম উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রয়োজন। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তি গড়ে তুলতে পারবে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার ভিত্তিতে আর্থিক খাতের উন্নয়ন করার আহ্বান জানানো হয়, যাতে দেশের জনগণের উন্নয়ন এবং আশা পূরণ সম্ভব হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত