রিসাইকেল পণ্যের চাহিদা বাড়লেও সচেতনতার অভাব

প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন এবং পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা ক্রমশ বাড়ছে। উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ও সচেতন ব্যবহারে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এর ফলে পরিবেশবান্ধব রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহারে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পোশাক উৎপাদনে খরচ বেশি হওয়ায় ক্রেতাদের দিক থেকে ন্যায্যমূল্য পরিশোধের অনীহা থাকায় এই খাতের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পোশাক খাতে বর্জ্যরে পুনর্ব্যবহার না বাড়ালে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি সংকুচিত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। ফলে বাংলাদেশকে পরিবেশবান্ধব রিসাইকেল পণ্যের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি দিতে হবে। গতকাল রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত একটি সেমিনারে এ কথা বলেন তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে যুক্ত ক্রেতা, উন্নয়ন সহযোগী এবং রপ্তানিকারক উদ্যোক্তারা। ইউনাইটেড নেশন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইউএনআইডিও), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ এই সেমিনারের আয়োজন করে। আলোচনায় পোশাক খাতের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়ে নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়া হয়।

ঝুট ব্যবসা ও রাজনীতি : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. আবদুর রহিম খান আলোচনায় বলেন, তৈরি পোশাকের ঝুট ব্যবসা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়েও প্রভাব ফেলছে। সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি পোশাক খাতের অস্থিরতার পেছনে ঝুট ব্যবসা বড় একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, একটি টেকসই পুনর্ব্যবহার কাঠামো তৈরি করা গেলে দেশের পোশাক শিল্পে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। ইইউ প্রতিনিধি দলের উপ-প্রধান ড. বার্ন্ড স্প্যানিয়ার বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবুজ চুক্তি বাস্তবায়নে বর্জ্যরে পরিবেশবান্ধব পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা অপরিহার্য। না হলে বাংলাদেশ থেকে ইইউ জোটের ২৭ দেশে পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তিনি বলেন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব, যা দেশের আমদানিনির্ভরতা কমাতে সাহায্য করবে। তবে এজন্য সঠিক নীতি কাঠামো এবং প্রযুক্তি বিনিয়োগ অপরিহার্য।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জ : বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক রিজওয়ান সেলিম বলেন, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে বছরে প্রায় চার লাখ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত হয়। বাকি বর্জ্য অতি কম মূল্যে বিক্রি করতে হয়। পোশাক খাতের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আরও কার্যকর সমাধান প্রয়োজন। তিনি বলেন, পুনর্ব্যবহারের মূল চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম ভোক্তা এবং ক্রেতাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব। যদি তারা ন্যায্য দাম দিতে রাজি হয়, তাহলে প্রতিটি কারখানা বর্জ্যরে পুনর্ব্যবহারে উৎসাহিত হবে। জার্মান উন্নয়ন সংস্থা জিআইজেডের প্রতিনিধি বলেন, পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রতিবেশ বান্ধব টেকসই ব্যবসার বিষয়ে সবাই সচেতন, তবে এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি বিনিয়োগ এবং লজিস্টিক সরবরাহের সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য উৎপাদনে খরচ বেশি হয়, আর যদি ভোক্তারা সেই মূল্য পরিশোধে অনীহা প্রকাশ করেন, তবে রপ্তানিকারকদের পক্ষে এই খাতে বিনিয়োগ লাভজনক হবে না।

পুনর্ব্যবহারযোগ্য খাতের উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট নীতি কাঠামো প্রয়োজন : ইউনিডোর চিফ টেকনিক্যাল অফিসার মার্ক ড্র্যাক বলেন, বাংলাদেশকে আগামীতে একটি টেকসই সার্কুলার ইকোনমির দেশ হিসেবে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। তা না হলে আগামী পাঁচ বছর পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ক্রমেই কমে আসতে পারে। তাই, টেকসই পোশাক শিল্পের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর নীতি কাঠামো অপরিহার্য। বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক এবং দেশ গার্মেন্টসের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভিদিয়া অম্রিত খান বলেন, পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত এবং নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন।

পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য উৎপাদনে ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং ন্যায্য মূল্য পরিশোধে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। একমাত্র এভাবেই পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পোশাক শিল্প নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে টেকসই চক্রাকার অর্থনীতির দিকে নিয়ে যেতে হলে পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট নীতি কাঠামো এবং ভোক্তা-ক্রেতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি। পুনর্ব্যবহারযোগ্য শিল্পে সম্ভাব্য কর্মসংস্থান এবং পরিবেশবান্ধব রপ্তানির সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে সার্কুলার অর্থনীতির মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।