রিজার্ভ বৃদ্ধির নতুন নীতিমালা কার্যকর : বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতন ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পরিবর্তন এনেছে, যার ইতিবাচক ফলাফল এরই মধ্যে দৃশ্যমান হচ্ছে। আগস্ট মাসে শুরু করে পরবর্তী দুই মাসে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ ও সরকারি দেনা পরিশোধের পরেও প্রতিমাসে রিজার্ভে সামান্য করে বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং বর্তমান পরিস্থিতি বেশ স্থিতিশীল। গত ২২ আগস্ট পর্যন্ত গ্রস রিজার্ভ ২৫ দশমিক ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়, যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মানদ-ে (বিপিএমণ্ড৬) প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার সমান। সেপ্টেম্বরে এই রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত এক মাসে রিজার্ভের বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
রিজার্ভের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে নতুন পদক্ষেপ : বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হোসনে আরা শিখা জানিয়েছেন, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় তিনটি মূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথমত, ব্যাংকগুলো আমদানি ঋণপত্র খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার চাইলে তা আর বিক্রি করা হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন (এসিইউ) ছাড়া অন্যত্র ডলার ব্যয় করে দেনা পরিশোধ করা হচ্ছে না। তৃতীয়ত, রেমিট্যান্স প্রবাহের বৃদ্ধি এবং ব্যাংকগুলোয় ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ঋণপত্রের জন্য ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলারের ব্যবস্থা করছে। এই পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের সংরক্ষণে সফল হয়েছে, যার ফলে রিজার্ভ ক্রমশ বাড়ছে।
সরকারি দেনা পরিশোধ ও বাজারের স্থিতিশীলতা : গভর্নর মনসুর উল্লেখ করেন যে, সরকারের বড় অঙ্কের দেনা পরিশোধ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সার, বিদ্যুৎ এবং আদানি-শেভরনের জন্য পরিশোধ করা হয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ। গত দুই মাসে জ্বালানি ও অন্যান্য অপরিহার্য সেবার দেনা ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে, যার ফলে সরকারের অপূরণীয় বিলের পরিমাণ ২৫০ কোটি ডলার থেকে নেমে ৭০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এ ছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক ডিসেম্বরের মধ্যে সমস্ত দেনা পরিশোধ করে ঋণমুক্ত হতে চায়। যদি এই লক্ষ্য অর্জিত হয়, তবে বাজারে তারল্য পরিস্থিতি আরো উন্নত হবে এবং অর্থনীতির ওপর চাপ কমে আসবে।
অতীতের সংকট এবং সাম্প্রতিক সমাধান : আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দুই বছরে, বেসরকারি খাতের প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারের স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল। একই সময়ে বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগ প্রবাহে হ্রাস ঘটে। ২০২৩ সালের ডলার সংকটের কারণে নিত্যপণ্য আমদানির জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়েছিল, যার ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ বৃদ্ধি পায় এবং দেশব্যাপী ডলার সংকট দেখা দেয়। এক পর্যায়ে ডলারের বিনিময় হার ১২৭ টাকায় পৌঁছায়। এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়। ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাফেদা ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সহায়তায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে প্রণোদনা দেয়া হয়। তবে, এই উদ্যোগেও ডলারের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায় এবং অনেক নিত্যপণ্যের আমদানিতে ব্যয় বৃদ্ধি ঘটে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করলেও পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি।
ডলার সংকটের সমাধানে বিশেষজ্ঞদের মতামত : অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ ব্যাংককে ডলারের সরবরাহ বাড়ানোর পরামর্শ দেন। এই পরামর্শ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে তিন বছর মেয়াদি ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই ঋণ সাময়িকভাবে রিজার্ভে চাপ কমাতে সহায়তা করলেও সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান করতে পারেনি।
ঋণ প্রাপ্তির প্রচেষ্টা এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা : ২০২৪ সালের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে এবং বৈদেশিক ঋণপ্রবাহ বাড়াতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের মতানুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছে।