চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ভেঙেছে আমদানির একচেটিয়া সিন্ডিকেট
প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, যা দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত, সেখানে দীর্ঘ দেড় দশকের পর আমদানির একচেটিয়া সিন্ডিকেট ভেঙে পড়েছে। আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ী ও নেতাদের প্রভাব কমে যাওয়ায় এখন ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরাও পণ্য আমদানির সুযোগ পাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, এর ফলে বাজারে শিগগিরই ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাবে। তবে ছোট ব্যবসায়ীরা এখনো ব্যাংকের এলসি খোলায় বৈষম্যের অভিযোগ করেছেন। গত ১৫ বছর ধরে খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্যের আমদানি বাজার মূলত নিয়ন্ত্রণ করেছিল কিছু বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপ চিনির বাজারে প্রধান প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ছিল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে এস আলম গ্রুপ ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে বেশ কয়েকটি ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানও অপরিশোধিত চিনি আমদানি করতে সক্ষম হয়েছে।
এই পরিবর্তন শুধু চিনির ক্ষেত্রেই নয়, ভোজ্য তেল, ডাল, পেঁয়াজ এবং গমের মতো অন্যান্য খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও ঘটেছে। খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ জাহেদী জানিয়েছেন, ‘বড় কোম্পানিগুলো বাজারে তাদের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করত। কিন্তু বর্তমানে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতামূলকভাবে আমদানিতে অংশগ্রহণ করতে পারছেন, যা ২০-২৫ বছর আগের পরিস্থিতির মতো। যদিও বড় ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কমেছে, তবু ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যাংক এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার ক্ষেত্রে এখনো বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছেন। ছোট ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন যে, বড় আমদানিকারকদের ক্ষেত্রে এলসি মার্জিন হার কম রাখা হলেও, ছোট পরিসরে আমদানির জন্য উচ্চ মার্জিন নির্ধারণ করা হচ্ছে। এটি তাদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করছে না বলে দাবি করেছেন আল হারামাইন ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী জাকের সওদাগর। তিনি বলেন, ‘৫০০ কনটেইনারের জন্য এলসি মার্জিন কম থাকে, কিন্তু পাঁচ কনটেইনারের জন্য তা অনেক বেশি। এতে ছোট ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান এই সমস্যার সমাধানে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যদি সরকার চান যে সব ধরনের ব্যবসায়ী ব্যবসায়িক সুযোগ পায়, তাহলে তাদের জন্য এলসি মার্জিনের নিয়মাবলী সহজ করা উচিত। চট্টগ্রাম চেম্বার এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনে পূর্বে এস আলম, টিকে, বিএসএম, সিটিসহ বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। তবে সাম্প্রতিক পরিবর্তনের ফলে এই গ্রুপগুলোর ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং অনেক মালিক ও ব্যবসায়ী নেতা আড়ালে চলে গেছেন। এতে করে ছোট ও মাঝারি আমদানিকারকরা তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ পাচ্ছেন।
এদিকে, অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যদি ছোট ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় বৈষম্য কমানো যায়, তবে পুরো বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং এর সুফল সারাদেশে পাওয়া যাবে। খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজার, যা চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানিকৃত খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত, প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার লেনদেন করে। দেশের অন্যান্য স্থানের পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোও এই বাজার থেকে সরবরাহিত পণ্যের ওপর নির্ভর করে। এ কারণেই বাজারের এই পরিবর্তন শুধুমাত্র খাতুনগঞ্জের জন্য নয়, বরং সারাদেশের অর্থনৈতিক চিত্রকেও প্রভাবিত করতে পারে। ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা আরো সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং পণ্যের মূল্যও স্থিতিশীল হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সার্বিকভাবে, খাতুনগঞ্জে বড় গ্রুপগুলোর প্রভাব কমে আসায় বাজারে নতুন প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সাম্যতা আনা এবং ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।