বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ কমাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অনুসরণ করে ঋণ শ্রেণিকরণের নতুন নিয়ম চালু করতে যাচ্ছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ঋণের কিস্তি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ না করলে তা খেলাপি হিসেবে গণ্য হবে। ঋণ মন্দ মানে পরিণত হলে ব্যাংকগুলোকে তার বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে জারি করা একটি সার্কুলারে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। আগামী ২০২৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে এ নির্দেশনা কার্যকর হবে।
নতুন নিয়মে কী পরিবর্তন আসছে? নতুন নিয়মে ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময়ের প্রথম দিন থেকে খেলাপি গণনার সূচনা হবে। তিন মাসের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করলে তা ‘নিম্নমান’ (Substandard), ৬ থেকে ১২ মাস হলে ‘সন্দেহজনক’ (Doubtful), এবং ১২ মাসের বেশি সময় পার হলে তা ‘মন্দ’ বা ‘ক্ষতিজনক’ (Bad) হিসেবে চিহ্নিত হবে। প্রভিশন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে, নিয়মিত ঋণের জন্য ঋণস্থিতির ১ শতাংশ, বিশেষ নজরদারিতে থাকা ঋণের জন্য ৫ শতাংশ, নিম্নমানের ঋণের জন্য ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের জন্য ৫০ শতাংশ এবং মন্দ ঋণের জন্য ১০০ শতাংশ সংরক্ষণ করতে হবে।
মানিলন্ডারিং ও সুদ ব্যবস্থাপনায় নতুন নির্দেশনা : সার্কুলারে বলা হয়েছে, যদি কোনো ঋণ নিম্নমান বা সন্দেহজনক মানে থাকে, তাহলে তার বিপরীতে সুদ আয়ের পরিবর্তে ‘সাসপেন্স অ্যাকাউন্টে’ সুদ জমা রাখতে হবে। মন্দ মানে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে সুদ চার্জ করা বন্ধ থাকবে। তবে কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে সুদ চার্জ করা হলে সেটি আয় হিসাবে গণ্য করা যাবে না। যদি কোনো খেলাপি ঋণ বা তার কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করা হয়, তাহলে সেটি ঋণ সমন্বয় হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের ব্যবস্থাপনা আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং দেশের ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা আনতে কার্যকর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেপ্টেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার পরিমাণ ২ লাখ ৯ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। রিট মামলায় আটকে থাকা ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্টে থাকা অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ঘোষিত খেলাপি ঋণের বাইরে অনাদায়ী ঋণের মোট পরিমাণ ৬ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে অনাদায়ী ঋণের হার প্রায় ৪১.৫০ শতাংশ।
অতীতের শিথিল নীতিমালার প্রভাব : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ২০২২ সালে এক নির্দেশনার মাধ্যমে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ সহজ করেন। এই নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো ঋণগ্রহীতা এককালীন ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৪ বার পর্যন্ত ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারতেন। ঋণ পরিশোধের জন্য সর্বোচ্চ ২১ বছর সময় দেয়া হতো। এই শিথিল নীতিমালার ফলে বড় খেলাপিরা দীর্ঘমেয়াদে ঋণ পরিশোধের সুযোগ পেলেও, তাদের অনেকেই এই সুযোগের অপব্যবহার করেন। ফলে ঋণ পুনঃতফসিল হলেও অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি।
গভর্নরের বক্তব্য ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ : বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। তিনি উল্লেখ করেন, অর্থঋণ আদালতসহ বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতা দূর করতে হবে। প্রয়োজনে বড় খেলাপিদের আর কোনো সুবিধা দেয়া হবে না। ড. মনসুর আরো বলেন, ‘নতুন নিয়মে ঋণ শ্রেণিকরণ এবং প্রভিশন ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক মানদ- অনুসরণ করা হচ্ছে। এতে করে ব্যাংকগুলো তাদের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারবে এবং খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আরো কঠোর হতে বাধ্য হবে।