বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) নিজস্ব অর্থায়নে যুক্ত হতে যাচ্ছে নতুন দুটি পণ্যবাহী জাহাজ। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ বোর্ড সভায় নিজ অর্থায়নে ৫৫ হাজার থেকে ৬৬ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার দুটি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কেনার এই সিদ্ধান্ত হয়। জানা যায়, বহরের আকার বাড়িয়ে মুনাফার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে প্রথমবারের মতো নিজস্ব অর্থে দুটি বাল্ক কার্গো জাহাজ (মালবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ : যা খাদ্যশস্য, কয়লা, আকরিক এবং সিমেন্ট পরিবহনের জন্য তৈরি করা হয়) কিনছে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি)।
সরকারিভাবে জাহাজ কিনতে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি বিবেচনায় ছিল এমন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে। বিএসসির নিজস্ব প্রয়োজনীয়তাও এক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে। সকল দিক বিবেচনা করে জাহাজ দুটি কেনার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসসি কর্তৃপক্ষ। এই দুই জাহাজের ধারণক্ষমতা হবে ৫৫ থেকে ৬৬ হাজার টন। আর এসব জাহাজ কিনতে খরচ হবে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা, যা আগামী ছয় মাসের মধ্যে বিএসসির বহরে যুক্ত হবে। মূলত, চীন থেকে জি-টু-জি ভিত্তিতে জাহাজ কেনার প্রকল্পটি থমকে থাকায় নিজস্ব অর্থায়নে জাহাজ কেনার এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে বিএসসি ধারাবাহিকভাবে লাভ করে যাচ্ছে।
ওই লাভের ধারা অব্যাহত রাখতে বিএসসি নিজেদের বহরে নতুন নতুন জাহাজ যুক্ত করতে চায়। কিন্তু জি-টু-জি ভিত্তিতে জাহাজ কেনায় ধীরগতির কারণে এখন নিজেদের টাকায় জাহাজ কেনার উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে চায়না এক্সিম ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় চীন থেকে চারটি জাহাজ কেনার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি)। ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন হওয়ার পর একই বছরের ১২ জুলাই সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেয় সরকার। কিন্তু অর্থায়ন জটিলতায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির ১০ নম্বর আদেশমূলে প্রতিষ্ঠা করা হয় দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন। প্রতিষ্ঠার চার মাসের মাথায় ১৯৭২ সালের ১০ জুন প্রতিষ্ঠানটির বহরে প্রথম যুক্ত করা হয় এমভি বাংলার দূত। এরপর এখন পর্যন্ত সর্বমোট ৪৪টি জাহাজ প্রতিষ্ঠানটির বহরে যুক্ত করা হয়। কিন্তু বয়সের কারণে এই জাহাজগুলো স্ক্র্যাপ হয়ে যাওয়ায় কমতে থাকে বিএসসির বহর। এক পর্যায়ে জাহাজ কমে ২০১৮ সালে দুটিতে নেমে আসে। এরপর ২০১৯ সালে চীন থেকে ৬টি জাহাজ কেনার পর সেটি ৮টিতে পরিণত হয়। এরপর আবার কমতে থাকে জাহাজের সংখ্যা। গত মাসে দুটি জাহাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করায় জাহাজের বহর এসে দাঁড়ায় ৫টিতে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএসসির বহরে সাতটি জাহাজ থাকলেও অক্টোবর মাসের শুরুতে ৩৭ বছরের পুরোনো বাংলার সৌরভ ও বাংলার জ্যোতি দুটি জাহাজে পরপর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ওই দুটি জাহাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বিএসসি। কয়েক বছরের ব্যবধানে বিএসসির বহর আবার কমতে থাকায় নতুন জাহাজ যুক্ত করতে উদ্যোগ নেয় প্রতিষ্ঠানটি।
এর অংশ হিসেবে চীন থেকে চারটি জাহাজ এবং কোরিয়া থেকে ৬টি জাহাজ কেনার প্রক্রিয়া শুরু করে বিএসসি। কিন্তু অর্থায়ন নিয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ওই প্রকল্পগুলো থমকে থাকায় এখন নিজস্ব অর্থায়নে দুটি জাহাজ কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর অংশ হিসেবে গত ৩০ অক্টোবর বিএসসির সর্বশেষ বোর্ড সভায় দুটি জাহাজ কেনার বিষয়টি সবার মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা হয়। প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে দুটি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত হয়। দুই জাহাজ বিএসসির বহরে যুক্ত হলে জাহাজভাড়া সাশ্রয় ও দেশীয় নাবিকদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশীয় পতাকাবাহী সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে জাহাজের সংখ্যা ১০৩টি। জাহাজ ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় বড় বড় শিল্প গ্রুপ জাহাজের বহর বাড়াচ্ছে।
অথচ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনে (বিএসসি) একসময় ৪৪টি জাহাজ ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির কারণে ২০১৮ সালে এসে বিএসসির বহরে জাহাজের সংখ্যা নেমে আসে মাত্র দুটিতে। ২০১৯ সালে বিএসসি ছয়টি নতুন জাহাজ কিনে বহরে জাহাজের সংখ্যা আটটিতে উন্নীত করে। এর মধ্যে ২০২২ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে রকেট হামলায় এমভি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক পর্যায়ে জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ফলে বিএসসির বহরে জাহাজের সংখ্যা নেমে আসে সাতটিতে। এখন বহরে জাহাজ আছে পাঁচটি। এগুলো বিদেশি অপারেটরকে দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে।
বিএসসির সূত্রে জানা যায়, বিএসসির বহরে এখন পর্যন্ত ৪৪টি জাহাজ যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে চীন থেকে ২০১৮ সালে এমভি বাংলার জয়যাত্রা, এমভি বাংলার অর্জন ও এমটি বাংলার অগ্রগতি এবং ২০১৯ সালে এমটি বাংলার অগ্রযাত্রা ও এমটি বাংলার অগ্রদূত যুক্ত হয়েছে বহরে। ১৯৮৬ সালে ডেনমার্কের তৈরি করা এমটি বাংলার সৌরভ বিএসসির বহরে যুক্ত হয় ১৫ জুন ১৯৮৭ সালে। আর ১৯৮৭ সালের তৈরি করা এমটি বাংলার জ্যোতি বহরে যুক্ত হয় একই বছরের ১৫ মে। এই দুটি জাহাজের পর যুক্ত হয়েছে ১৯৮৮ সালে এমভি দূত, ১৯৮৯ সালে এমভি বাংলার মুখ ও এমভি বাংলার শিখা এবং ২০১৮ সালে এমভি বাংলার সমৃদ্ধি। এর মধ্যে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কমিশনিং বন্ধ হয়ে যায় ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধির’। এ জন্য বীমা প্রতিষ্ঠান থেকে ১৫৩ কোটি ৭৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে সংস্থাটি। তবে বাকি তিনটি জাহাজ স্বাভাবিক নিয়মে বাতিল হয়ে যায়। এছাড়া ‘বাংলার জ্যোতি’ ও ‘বাংলার সৌরভ’ নামে দুটি লাইটার জাহাজ, বহির্নোঙরের মাদারভ্যাসেল থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারির ডলফিন জেটিতে তেল আনায়নের কাজ করত। দুটি জাহাজই সম্প্রতি হওয়া অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বাতিল হয়ে যায়। এছাড়া সক্রিয় রয়েছে পাঁচটি। এসব জাহাজ থেকে সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিএসসি ৫৩ বছরে সর্বোচ্চ ২৫০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এ সম্পর্কে বিএসসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বোর্ড সভায় নিজস্ব অর্থায়নে দুটি জাহাজ কেনার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে সাড়ে সাতশ থেকে আটশ কোটি টাকায় ৫৫ থেকে ৬৬ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার দুটি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কেনা হবে। যত দ্রুত এ দুটি জাহাজ বহরে যুক্ত করা যায় আমরা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে পর্যাপ্ত দেশীয় জাহাজ না থাকায় পণ্য পরিবহনে বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে বাইরে। এ অবস্থায় জাহাজের ভাড়া সাশ্রয় ও নাবিকদের চাকরির সুযোগ বাড়াতে দেশীয় জাহাজের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।