বোরো মৌসুমের পর চালের দাম বাড়তে থাকায় ক্রেতাদের আশা ছিল আমন মৌসুমে কমবে। বাজারে এমন আলামতও দেখা যাচ্ছিল। আমন মৌসুমের শুরুতে কিছু কিছু চালের দাম এক-দুই টাকা কমেও ছিল। কিন্তু হঠাৎ গত সপ্তাহ থেকে বাড়তে থাকে। চলতি সপ্তাহে এই গতি আরো বেড়েছে। বাজার তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আর দুই সপ্তাহের হিসাবে তা ৫ টাকা পর্যন্ত। এমন পরিস্থিতিতে আগামী এক-দুই সপ্তাহে দাম আরো বাড়তে পারে এমন আভাস মিলেছে ব্যবসায়ীদের কথায়। আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকায় ক্রেতার সঙ্গে হতাশা প্রকাশ করেছেন খুচরা বিক্রেতারাও।
পাইকারি ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে চালের দাম বাড়ার চারটি কারণ পাওয়া যায়। তারা বলছেন, আমনের উৎপাদন ঘাটতিতে ধানের দাম বাড়া, মিল ও পাইকারি পর্যায়ে বাফার স্টক না থাকা, সরকারি গুদামের মজুত কমে যাওয়া ও সার্বিক মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যগুলোর দাম বেড়ে যাওয়াই চালের দাম বাড়ার মূল কারণ। গতকাল রাজধানীর মালিবাগ, রামপুরা, মানিকনগর, সেগুনবাগিচাসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সরু চালের দাম। বিক্রেতারা জানান, এসব চাল সাধারণত বোরো মৌসুমের ধান থেকে আসে। আমন মৌসুমে আসে স্বর্ণা ও ব্রি-২৮ জাতের চাল।
সরু চালের মধ্যে সাধারণত নাজিরশাইল বা জিরানাজির জাতের চালই বেশি বিক্রি হয়। এছাড়া নন-ব্র্যান্ডের চালও রয়েছে। মানভেদে নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮৫ টাকা, চলতি সপ্তাহের শুরুতেও এই মানের চাল বিক্রি হয়েছে ৭৩-৮২ টাকা কেজি। এছাড়া এসব ব্র্যান্ডের মিনিকেটের পাশাপাশি মোজাম্মেল, রসিদ, মঞ্জুর, সাগর, ডায়মন্ডসহ নন-ব্র্যান্ডের মিনিকেট বা জিরাশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে বাজারে। গত বৃহস্পতিবার বাজারগুলোতে মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৭৩-৭৬ টাকায়, চলতি সপ্তাহের শুরুতেও এই চালের দাম ছিল ৭০ থেকে ৭২ টাকা কেজি। সরু চালের পাশাপাশি মাঝারি ও মোটা চালের দামও কেজিতে ২-৪ টাকা বেড়েছে। মাঝারি মানের ব্রি-২৮, ব্রি-২৯, পাইজাম চালের কেজি এখন ৬২-৬৪ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ৫৮-৬০ টাকা ছিল। মানভেদে মোটা স্বর্ণা চাল বর্তমানে ৫২-৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগে ৫০-৫৫ টাকা ছিল। রাজধানীর মানিকনগর বাজারের চাল বিক্রেতা মরিয়ম স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. ইউসুফ বলেন, ‘চালের দাম হঠাৎ কেজিতে ৪-৫ টাকা বেড়েছে। পাইকারি বিক্রেতারা ভারতে দাম বাড়ার কথা বলছেন। এছাড়া মিলমালিকেরা দাম বাড়ানোর দাবিও করছেন। আমন মৌসুমে কেন দাম বাড়বে, তার প্রকৃত কারণ বুঝতে পারছি না। আমরা বাড়তি দামে কিনলে বিক্রিও সে অনুসারে করতে হয়। দাম বাড়লে আমাদের বিক্রি কমে। এখন পর্যন্ত আমরা সপ্তাহের শুরুতে যে চাল কিনেছিলাম, তা-ই বিক্রি করছি। পাইকারি বাজারে নতুন করে আরো বেড়েছে, সে চাল এলে আরো বাড়তে পারে।’ শুধু খুচরায় নয়, পাইকারিতেও চালের দাম গত এক সপ্তাহে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। চালের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার রাজধানীর বাবুবাজারে গতকাল মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৭০-৭২ টাকা কেজি, যা এক সপ্তাহ আগে ৬৬-৬৮ টাকা ছিল। নাজিরশাইল বিক্রি হয়েছে ৭৩-৭৪ টাকা কেজি, এই চালও সপ্তাহখানেক আগে ৩-৪ টাকা কম ছিল। ব্রি-২৭, ব্রি-২৯ বিক্রি হয়েছে ৫৫-৬০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫২-৫৬ টাকা কেজি। পাইজাম ও স্বর্ণা ৫০-৫৬ টাকা বিক্রি হয়েছে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫০-৫২ টাকা। মিলমালিক ও ব্যবসায়ীদের দাবি, গত দুই সপ্তাহে কৃষক পর্যায়ে ধানের দাম মণপ্রতি ৭০-৮০ টাকা বেড়েছে, যা চালের দামে প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ও বাবুবাজারের ব্যবসায়ী কাউসার আজম বলেন, ‘দেশে যখন সব পণ্যের দাম বাড়ে, তখন কৃষককেও ধানের দাম বাড়াতে হয় এবং চাল বিক্রেতাকেও চালের দাম বাড়াতে হয়। নাহলে সংসারে তার যে বাড়তি খরচ হচ্ছে, সেটা জোগাবে কোত্থেকে? তাদেরও খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। চালের দাম বাড়ার এটা একটা কারণ। এ ছাড়া এখন মিলগুলোতে বাড়তি মজুত রাখে না। প্রতিদিন ধান কিনে চাল তৈরি করে বিক্রি করছে। অথচ আগে মিলগুলো এবং একই সঙ্গে পাইকারি ব্যবসায়ীদের গুদামে এক-দুই সপ্তাহের বাফার স্টক থাকত। এতে যদি কোনো কারণে কয়েক দিন সরবরাহে সমস্যা হতো, তবে হঠাৎ করে বাজারে প্রভাব পড়ত না।’ তবে সরকারি গুদামে চালের মজুত কমে আসাও বাজারে দাম বাড়ার অন্যতম কারণ, বলছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘সরকারের ঘরে চালের মজুত কমে গেলে তার ফায়দা লোটে ব্যবসায়ীরা। তারা তখন যেমন খুশি দাম নির্ধারণ করে। কারণ তারা বুঝে ফেলে, বাজারে সরকারের সাপোর্ট ক্ষমতা কমে গেছে। এ পরিস্থিতি এড়াতে সরকারকে সব সময় চালের সরকারি মজুত সাড়ে ১২ লাখ টন রাখতে হবে। এটি দেশের ১৫ দিনের খাদ্য মজুত।