মৌসুমভিত্তিক কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণে কমিশন গঠনের দাবি

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্মের সংলাপ

প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশে কৃষি খাতে যতখানি উন্নতি হয়েছে, ততখানি কৃষকের উন্নতি হয়নি। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে রক্ষায় ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা মূল চ্যালেঞ্জ। এ জন্য চাল ডালসহ বিভিন্ন নিত?্যকৃষিপণে?্যর মৌসুমভিত্তিক মূল?্য নির্ধারণে কৃষক, কৃষি খাতের সঙ্গে যুক্ত সব পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘কৃষিপণ্য মূল্য কমিশন’ গঠনের দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

গতকাল রোববার ‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্ম, বাংলাদেশ’ আয়োজিত ‘চালের দাম বাড়ছে কেন? কার লাভ, কার ক্ষতি’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংলাপে এ দাবি তোলা হয়। এসডিজি প্লাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মুহা. ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক, অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. কাজী শাহাবুদ্দিন, সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান, চ্যানেল আইয়ের বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ, বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবির, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. নাজিরুল ইসলাম, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম, বাংলাদেশ রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ আলম বাবু সংলাপে বক্তব্য রাখেন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ও এসডিজি প্লাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য কৃষিপণ?্য মূল?্য কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে বলেন, ভারতে এই পদ্ধতি খুব কাজে দিয়েছে। বাংলাদেশে শুধুমাত্র আমলাতান্ত্রিক বা গবেষকের মতামতের ওপর নির্ভর না করে প্রকৃত উৎপাদকের সঙ্গে এবং বাজারসংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে কৃষিপণ?্য মূল?্য কমিশন গঠন প্রয়োজন। একটি এগ্রিকালচারাল প্রাইস কমিশন গঠন করা দরকার, যাতে তারা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্ষেপণ দিতে পারে। একই সঙ্গে মধ?্যমেয়াদি, স্বল্পমেয়াদি দাম নির্ধারণ করবে।

চালের দাম নিয়ে তিনি বলেন, চালের দামের ক্ষেত্রে নজরদারির প্রয়োজনীয়তা রয়ে গেছে। কৃষির উন্নতি হয়েছে, কিন্তু কৃষকের তো সেভাবে উন্নতি হলো না। সরকারের ধান-চাল মজুদ করার সক্ষমতা কম হওয়ার কারণে বেশিরভাগ সময়ই সরকারের পক্ষে বাজার প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে না। এ বছর মাঠপর্যায় থেকে আমন উৎপাদনের সঠিক সিদ্ধান্ত আসেনি। চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিতেও দেরি হয়েছে। এসব কারণে বাজারে চালের দাম কিছুতেই কমছে না। এছাড়া চালের বাজারে বড় বড় কিছু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রবেশ করায় তারা মজুদ করে রেখেছে। ছোট ছোট মিলাররা নানা সমস্যায় জর্জরিত। ফলে চালের বাজারে সিন্ডিকেটও রয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য মুহা. ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক বলেন, কৃষি খাতে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন ভর্তুকি ও উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন এবং বলেন, এ সব সুবিধা কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকার বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে।

দেশের উত্তরা, দক্ষিণ ও হাওর অঞ্চলের ৯ জেলার কৃষক, কৃষানি এবং কৃষি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা সংলাপে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। তারা বলেন, মিল মালিকরা আগেই ধান কিনে মজুত করে রাখে, যে কারণে চালের দাম বাড়লেও কৃষক তার মূল্য পায় না। ধান চাষে খরচের তুলনায় কম দামে বিক্রি করতে হয়, তাই কৃষক ধান চাষ থেকে সরে আসছেন। সরকার যে ধান সংগ্রহ করেন সেখানে সবাই অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তাই কম দামে মিল মালিকের কাছে বিক্রি করতে হয়।

ধান চাষে লাভবান না হওয়ায় ধানের উৎপাদন ক্রমাগত কমছে বলে মনে করেন চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ। তিনি বলেন, কৃষি খাতে অনেকে ধান চাষ থেকে উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় এবং চাষযোগ্য জমি কমে আসায় ধান চাষের ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হচ্ছে। সরকারি গুদামে ছোট কৃষকদের ফসল সংরক্ষণ করার সুযোগ করে দিতে হবে যেন ফসলের সঙ্গে সঙ্গে কৃষককে অল্প দামে ফসল বিক্রি না করতে হয়। বিআইডিএস’র সাবেক মহাপরিচালক ড. কাজী শাহাবুদ্দিন বলেন, সরকারের বর্তমানে খাদ্যশস্য মজুত পর্যাপ্ত নয় এবং এটি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি। একই সংস্থার সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, বাজারে চালের দাম বাড়লেও এ বাড়তি দামের কারণে কৃষক লাভবান হয় না। কৃষক অনেক আগেই কম দামে ধান বিক্রি করে দেয়।

বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, সরকার প্রকৃত কৃষকের থেকে চাল না কিনে মিলারদের থেকে ক্রয় করছে, তাই কৃষক উপকৃত হচ্ছে না। মিলারদের ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মজুতদারির কারণে বাজারে চালের অপর্যাপ্ততা রয়েছে। প্রতিবছর বাম্পার ফলনের পরও কারণ ছাড়া চালের দাম বাড়ে। সরকারকে স্থানীয় পর্যায়ে ক্রয় কেন্দ্র করে সরাসরি কৃষক থেকে চাল ক্রয় করার পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম খোরশেদ আলম খান বলেন, মিলাররা মৌসুমের শুরু থেকেই কৃষকদের থেকে ১ হাজার ৫০ টাকায় ধান কিনেছে। চালের এ বাম্পার ফলনের কথার সঙ্গে দ্বিমত করে বলেন, এ মৌসুমের শুরু থেকেই সরবরাহ কম ছিল।

ধান ও চালের তথ্য বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবির বলেন, উৎপাদনের প্রাক্কলনে কোনো ভুল ছিল না। প্রাক্কলন সঠিক ছিল। এবার খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা নেই।