ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বায়তুল মোকাররমের জুমার বয়ান

সুষ্ঠু সমাজ গঠনে নির্দেশনা

মুফতি রুহুল আমিন
সুষ্ঠু সমাজ গঠনে নির্দেশনা

ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি হলো- তাওহিদ, রেসালাত ও আখেরাত। তাওহিদ অর্থ ঈমান আনা; শরিয়ত ঈমানের যেসব শাখা বর্ণনা করেছে, সেগুলোর ওপর যথাযথভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা। রেসালাত অর্থ আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে প্রেরিত নবী-রাসুলদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা। ঈমানের এ দুটি গুণ আমাদের অধিকাংশ মুসলমানের মাঝে পাওয়া যায়। তবে তৃতীয় গুণটি নিয়ে অনেকে সন্দিহান। অনেকে মনে করে, মানুষ মরে যাওয়ার পর আমরা যখন কবরে রাখি, তার কয়েকদিন পরেই তার লাশটি গলে যায়, পচে যায় এবং মাটির সঙ্গে মিশে যায়। কখনও কবর খনন করা হলে বা কোনো কারণে কবর ভেঙে গেলে আমরা সেখানে কিছু হাড্ডি দেখতে পাই অথবা কোনো ব্যক্তি পানিতে পড়ে মারা গেলে তার শরীর পচে যায়, ফুলে যায় এবং তা মাছে খায় কিংবা কাউকে মেরে কেটে কেটে টুকরো করে ফেলে দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা ফের মানুষকে জীবিত করবেন, তার দেহে প্রাণ সঞ্চয় হবে, তাকে কবরে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হবে, এটা তো বিজ্ঞানের এ যুগে বিশ্বাস করা অনেক কঠিন। এমন উদ্ভট বিভিন্ন ধোঁকা শয়তান মানুষকে দিয়ে থাকে। শয়তানের ধোঁকা সব সময় যুগোপযোগী এবং ব্যক্তি বিশেষ তার বুঝ অনুযায়ী দিয়ে থাকে। যে যেভাবে বুঝতে চায়, শয়তান তাকে সেভাবেই ধোঁকা দিয়ে থাকে।

আল্লাহ সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান

আল্লাহতায়ালার অশেষ মেহেরবানি, যদি আমরা একটু অনুতপ্ত হই, আল্লাহতায়ালার দিকে রুজু হই এবং তওবা করি, তাহলে শয়তানের ওসব কুমন্ত্রণা নিমিষেই হারিয়ে যায়। এ জন্য আমাদের শতভাগ বিশ্বাস রাখতে হবে, আল্লাহতায়ালা সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। তিনি যা ইচ্ছে করতে পারেন। তিনি যেমন দুনিয়ায় আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তদ্রƒপ পরকালেও আমাদের পুনর্জীবিত করবেন। লাশ টুকরো টুকরো করে এদিক-সেদিক ফেলে দিলেও আল্লাহতায়ালার এক হুকুমে সব একত্রিত হয়ে যাবে। পচে গলে পানির সঙ্গে মিশে গেলেও আল্লাহতায়ালার এক হুকুমে সব একত্রিত হয়ে যাবে। যেমন কোরআনে ইবরাহিম (আ.)-এর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্মরণ কর যখন ইবরাহিম বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে দেখাও, কেমন করে তুমি মৃতকে জীবিত করবে। আল্লাহ বললেন, তুমি কি বিশ্বাস কর না? বলল, অবশ্যই বিশ্বাস করি; কিন্তু দেখতে এ জন্য চাইছি, যাতে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করতে পারি। বললেন, তাহলে চারটি পাখি ধর। সেগুলোকে পোষ মানিয়ে নাও। এরপর সেগুলোর দেহের একেকটি অংশ বিভিন্ন পাহাড়ে রেখে দাও। তারপর সেগুলোকে ডাক; তোমার কাছে দৌড়ে চলে আসবে। আর জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, অতি জ্ঞানসম্পন্ন।’ (সুরা বাকারা : ২৬০)। তাই আমাদের ফের জীবিত করা হবে। আমাদের সব কৃতকর্মের হিসাব হবে। যত জুলুমণ্ডনির্যাতন করছি, তার হিসাব দিতে হবে।

সবাইকে একই পরিবারের মনে করা চাই

বর্তমান যমানায় দেখা যায়, অনেক মানুষ মারণাস্ত্র তৈরি করছে। এখান থেকে সুইচ চাপ দিলে দু-তিন হাজার মাইল দূরে গিয়ে আঘাত করে। আবার তাদেরও এমন অস্ত্র রয়েছে, যা দিয়ে আঘাত করে এটাকে প্রতিহত করে। এভাবে সারা পৃথিবীতে একটা অশান্তি বিরাজ করছে। লাখো মানুষের নিষ্পাপ প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। এত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে মারণাস্ত্র না বানিয়ে আমরা যদি পরস্পরের প্রতি আন্তরিক হতাম, একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হতাম, যে যেখানে আছি, যে ধর্মেরই হই না কেন, আমরা সহাবস্থান বেছে নিই, সবাইকে একই পরিবারের মনে করি। আলাদা আলাদা সীমানা থাকতে পারে, মতাদর্শ ভিন্ন হতে পারে, তারপরও যদি আমরা এসব মরণাস্ত্র না বানিয়ে ভালো কাজে অর্থ ব্যয় করতাম, তাহলে পৃথিবী আরও শান্ত হতো, মানুষ আরও সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারত; পৃথিবীর সময় হয়তো আরও কিছুদিন বেড়ে যেত। পৃথিবীর সব সৃষ্টিজীব সুখময় জিন্দেগি যাপন করত।

দুনিয়ার হায়াত যেভাবে বাড়ে

যে কোনো বিষয়ের দুই ধরনের জিনিসের সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে- এক. পৃথিবীর বিভিন্ন ধরনের উপায়-উপকরণ, দুই. মেধা ও জ্ঞান। এ দুটির সমন্বয়ে কোনো জিনিস আবিষ্কার করে যদি আল্লাহতায়ালার শুকরিয়া আদায় করা হয়, তাহলে এ উপযুক্ত পন্থা অবলম্বনের কারণে হতে পারে এটার স্থায়িত্ব বেশি হবে, এটা বেশি দিন টিকবে। যেমন- মানুষ যদি বেশি বেশি দোয়া করে বা নেক আমল করে, তাহলে তার হায়াত বৃদ্ধি পায়, বিপদাপদ কম আসে। এটাকে বলা হয় তাকদিরে মুয়াল্লাক। ঠিক দুনিয়ার হায়াত আছে। দুনিয়াবাসী যদি সব ধরনের মারামারি-কাটাকাটি ছেড়ে দেয়, সবাই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং পরস্পরে পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিধান মতো জীবন পরিচালনা করে, তাহলে কেয়ামত পরে হবে, দুনিয়ার হায়াত বেড়ে যাবে। দুনিয়া হবে সুখময়।

দুর্যোগ-বিপর্যয় আমাদের হাতের কামাই

দুনিয়াকে আল্লাহতায়ালা মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তৈরি করেছেন; কিন্তু আমরা বিভিন্ন ধরনের পাপাচারে লিপ্ত হয়ে, মারামারি-কাটাকাটি করে, খুন-খারাবি করে দুনিয়ার শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করে তুলেছি। দুনিয়াকে বসবাসের অনুপযোগী করে দিয়েছি। পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে সব ধরনের বিপদাপদ আমাদের চেপে ধরেছে। আগুন লেগে গ্রামকে গ্রাম পুড়ে যাচ্ছে। পানিতে ডুবে মানুষের বসতবাড়ি ভেসে যাচ্ছে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে। করোনাভাইরাস, ক্যান্সার ও বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হয়ে লাখো মানুষ মারা যাচ্ছে। এ সবকিছু আমাদের হাতের কামাই। আমাদের পাপাচারের কারণেই হচ্ছে। এ জন্য আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের কারণে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান; যেন তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রুম : ৪১)।

প্রত্যেককেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে

যে কোনো ধরনের পাপাচার ও খারাপ কাজ থেকে এবং যেসব কাজে দেশের শৃঙ্খলা ও সুন্দর পরিবেশ বিনষ্ট হয়, সেসব কাজ থেকে আমাদের প্রত্যেককে বিরত থাকতে হবে। প্রত্যেকে যদি মনে করে, এ খারাপ কাজটি শুধু আমি করলে কি হবে? সবাই তো ভালো কাজই করবে। এভাবে দেখা গেল, সবাই খারাপ কাজ করছে। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। পাপাচারের কারণে বিভিন্ন ধরনের আজাব আসছে। তাহলে রাজার পুকুরে দুধ দেওয়ার মতো হবে। প্রত্যেকে মনে করল, শুধু আমি পানি ঢাললে কি হবে? সবাই তো দুধই দেবে। দেখা গেল, কেউ দুধ দিল না; সবাই পানি দিল। লক্ষ্যবস্তু কিছুই হাসিল হলো না। বরং আমাদের উচিত হবে, আমরা প্রত্যেকেই যার যার স্থান থেকে এভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হব যে, যে যা-ই করুক না কেন, আমি ভালো কাজ করব, আমি ভালো হয়ে চলব। সমাজ দূষিত হয়, এমন কোনো কাজ আমি করব না। কোনো পাপাচারে লিপ্ত হব না।

যে কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে বরকত থাকে না

আজকাল দেখা যায়, শহরের অনেক মানুষ অনেক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কিছু টাকা খরচ করে ভিন্ন কোনো পন্থা অবলম্বন করা ছাড়াই তাদের গার্মেন্টস বা ফ্যাক্টরির পানি সরাসরি নদীতে ছেড়ে দেয়। এতে নদীর পাড় দূষিত হয়। আবার সে পানি যখন মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে আর মানুষ তা ব্যবহার করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, তখন এসব মানুষের ক্ষতি করার কারণে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বরকত থাকে না। তখন বাধ্য হয়ে ঋণখেলাপি করে। বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আর অপরাধ যখন মানুষ একাকী গোপনে করে, তখন তার ক্ষতি শুধু তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আর যখন প্রকাশ্যে করে, কেমন যেন সে পাপাচারের দাওয়াত দিচ্ছে। তখন তার ক্ষতি পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। রাষ্ট্র যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তার দায়ভার জনগণকে নিতে হয়। এ জন্য ইসলাম শিক্ষা দেয়, সব ক্ষেত্রে কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক চলাফেরা করতে হবে। আমাদের চালচলন, লেবাস-পোশাক, ওঠাবসা সবকিছুর মধ্যে যেন একটা ভিন্নতা অনুভব হয়।

অশান্ত পরিবেশকে শান্ত করতে হবে

দেশের কোনো প্রশাসনের লোক যদি কেউ দেখে, তাহলে সহজে অনুমান করতে পারে, এরা পুলিশ, এরা বিডিআর বা এরা এই কোম্পানির লোক। যেমন- সাহাবায়ে কেরাম যখন কোনো এলাকায় যেতেন, তখন তাদের লেবাস-পোশাক, চালচলন, ওঠাবসা দেখে সবাই তাদের কাছে ভিড়ত। তাদের এত সুন্দর চলাফেরার কারণ জেনে সে অনুযায়ী চলার চেষ্টা করত। ফলে কিছুদিনের মধ্যে তাদের অশান্ত পরিবেশ শান্ত হয়েছে। আর নবীজি (সা.) তাদের জাহেলি সমাজকে শ্রেষ্ঠ যুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং আমাদেরও প্রতিটি ক্ষেত্রে সেভাবে চলতে হবে। ইসলাম অনুযায়ী চলে দেশের অশান্ত পরিবেশকে শান্ত করতে হবে। একটি সুষ্ঠু সুন্দর আদর্শ সমাজ গড়তে হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের তৌফিক দান করুন। আমিন।

১৫ পৌষ ১৪২৯ (৩০ ডিসেম্বর ২০২২) তারিখে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে প্রদত্ত জুমার বয়ানের সংক্ষেপিত শ্রুতলিখন করেছেন মুফতি মাহবুবুর রহমান

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত