মহানবীর দয়াশীলতা
আবদুল কাইয়ুম শেখ
প্রকাশ : ০৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দয়ার সাগর, ক্ষমার আকর ও করুণার মূর্ত প্রতীক ছিলেন প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.)। মানব-দানব, পশু-পাখি, তরুলতাসহ বিশ্বের প্রতিটি বস্তুর প্রতিই ছিল তার দয়া ও অনুকম্পা। মহান আল্লাহ তাঁকে এ পৃথিবীতে বিশ্ববাসীর করুণাস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য করুণাস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭)। বিশ্বনবী (সা.) উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল, স্নেহশীল ও হিতাকাক্সক্ষী ছিলেন। নবীজি (সা.)-এর কল্যাণকামিতা, দয়াশীলতা ও অনুকম্পার এ গুণটি বর্ণনা করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসুল। তোমাদের দুঃখণ্ডকষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মোমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।’ (সুরা তওবা : ১২৮)।
সব মুসলিম এক ব্যক্তির সমতুল্য
মহানবী (সা.)-এর দয়াশীলতা এত সর্বব্যাপী ও পরিব্যাপ্ত ছিল যে, তিনি সব মুসলমানকে এক দেহের সমতুল্য মনে করতেন। কোনো ব্যক্তি তার দেহের একটি অংশে যদি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাহলে সারা দেহে ব্যথা অনুভব করে। অনুরূপভাবে বিশ্বনবী (সা.)-এর দৃষ্টিতে একজন মুসলমান আক্রান্ত হলে সারা মুসলিম জাতি আক্রান্ত হয়। নোমান ইবনে বশির (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সব মুসলিম এক ব্যক্তির সমতুল্য। যদি তার চোখ পীড়িত হয়, তবে সমগ্র দেহ পীড়িত হয়ে পড়ে। যদি তার মাথা আক্রান্ত হয়, তাহলে সমগ্র শরীরই আক্রান্ত হয়ে পড়ে।’ (মুসলিম : ৬৪৮৩)।
ঋণ শোধ করার দায়িত্ব আমার
একজন আত্মীয় অপর আত্মীয়ের প্রতি দয়া ও ভালোবাসার আচরণ করে থাকে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্বনবী (সা.) মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি নিকটাত্মীয়। উম্মতের প্রতিটি সদস্যের প্রতি রাসুল (সা.)-এর ব্যবহার নিকটাত্মীয়দের চেয়েও বেশি দরদমাখা ছিল। জাবের (রা.) বলেন, যখন আল্লাহতায়ালা রাসুল (সা.)-কে মক্কা বিজয় দান করলেন, তখন তিনি বললেন, ‘আমি প্রত্যেক মোমিনের কাছে তার নিজ অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর। যে ব্যক্তি ঋণ রেখে যায়, তা পরিশোধ করার দায়িত্ব আমার। আর যে ব্যক্তি ধন-সম্পদ রেখে যায়, তা তার ওয়ারিশদের।’ (সুনানে নাসায়ি : ১৯৬২)।
আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন
কিছু কিছু লোক হয়ে থাকে পাষাণপ্রাণ, নির্দয় ও নিষ্ঠুর। এমন লোকদের মানুষ ঘৃণা করে। তাদের কাছ থেকে লোকজন দূরে সরে যায়। রাসুল (সা.) এমন ছিলেন না। তিনি ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী। অন্যের দুঃখণ্ডদুর্দশা অনুভব করে তা দূর করার চেষ্টা করতেন। এ কারণে বিপুল সংখ্যক লোক তার মতাদর্শ গ্রহণ করে তারই আশপাশে জড়ো হয়েছিল। ফলে তিনি মাত্র তেইশ বছরে সারা পৃথিবীতে ইসলামের অভাবনীয় বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে ঐতিহাসিক বিপ্লব আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগে শুরু হয়েছিল, তার ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ। মহানবী (সা.) দয়ার্দ্র অন্তর ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৫৯)।
আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তর থেকে দয়া দূর করেন
শিশুদের প্রতি মহানবী (সা.) অত্যন্ত দয়াশীল ও স্নেহবৎসল ছিলেন। নামাজরত অবস্থায় যদি তিনি কোনো শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেতেন, তাহলে নামাজ সংক্ষিপ্ত করে দিতেন; যেন সেই শিশুর মা তাকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াতে পারে। অনেক সময় মহানবী (সা.) শিশুদের চিবুক ধরে আদর করতেন। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন ও চুমু খেতেন। একবার কিছু বেদুইন এসে দেখল, মহানবী (সা.) একটি শিশুকে চুমু খাচ্ছেন। তখন তারা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা শিশুদের চুম্বন করেন?’ সাহাবায়ে কেরাম উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। তখন বেদুইন লোকেরা বলল, ‘আমরা আমাদের শিশুদের চুম্বন করি না।’ এ কথা শুনে মহানবী (সা.) বললেন, ‘মহান আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তর থেকে স্নেহ ও দয়াশীলতা তুলে নেন, তাহলে আমাদের কি করার আছে?’ এ প্রসঙ্গে আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-এর কাছে গেঁয়ো আরবীয় লোক এলো। তারা প্রশ্ন করল, ‘আপনারা কি আপনাদের বাচ্চাদের চুমু দেন?’ উপস্থিত সবাই বললেন, ‘হ্যাঁ’। তখন তারা বলল, ‘কিন্তু আল্লাহর শপথ! আমরা তাদের চুমু দিই না।’ তারপর রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি কি করব, আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তর থেকে দয়া দূর করে দিয়ে থাকেন।’ (মুসলিম : ৫৯২১)।
কষ্টকর কাজে তাদের সহযোগিতা করবে
কর্মকর্তা-কর্মচারী, সেবক-সেবিকা ও চাকর-চাকরানিদের প্রতিও মহানবী (সা.)-এর দয়া ও অনুকম্পা সমানতালে বিদ্যমান ছিল। তিনি নিজের অধীন কর্মকর্তা-কর্মচারী, সেবক-সেবিকা ও চাকর-চাকরানিদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতেন। শুধু তাই নয়, অন্য লোকেরাও যেন নিজেদের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চাকর-চাকরানিদের প্রতি সদয় ব্যবহার করে, সে ব্যাপারে জোর নির্দেশ দিতেন। তাদের কষ্ট লাঘব করার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। আবু যর (রা.) বলেন, একবার আমি এক ব্যক্তিকে গালি দিলাম। তাকে তার মা সম্পর্কে লজ্জা দিলাম। তখন রাসুল (সা.) আমাকে বললেন, ‘আবু যর! তুমি তাকে তার মা সম্পর্কে লজ্জা দিয়েছ? তুমি তো এমন ব্যক্তি, তোমার মধ্যে এখনও অন্ধকার যুগের স্বভাব বিদ্যমান। জেনে রেখ, তোমাদের দাস-দাসী তোমাদেরই ভাই। আল্লাহতায়ালা তাদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তাই যার ভাই তার অধীনে থাকবে, সে যেন নিজে যা খায়, তাকে তা-ই খাওয়ায় এবং নিজে যা পরিধান করে, তাকেও তা-ই পরায়। তাদের ওপর এমন কাজ চাপিয়ে দিও না, যা তাদের জন্য অধিক কষ্টদায়ক। যদি এমন কষ্টকর কাজ করতে দাও, তাহলে তোমরাও তাদের সে কাজে সহযোগিতা করবে।’ (বোখারি : ৩০)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা